
ছবি: সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুক্রবার রাতের এক নাটকীয় ঘোষণায় জানালেন, তিনি চীনের সব ধরনের রপ্তানি পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করছেন। বেইজিং সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ বিরল খনিজ (রেয়ার আর্থ এলিমেন্টস) রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করায় এই পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছেন ট্রাম্প।
দ্য গার্ডিয়ান ও সিএনএন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের ঘোষণার পর মুহূর্তের মধ্যে ওয়াল স্ট্রিটে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রধান সূচকগুলো একযোগে পতন ঘটায়, কারণ বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা—এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে নতুন করে শুরু হতে পারে আরও একটি ভয়াবহ বাণিজ্যযুদ্ধ।
শুক্রবার রাতের ট্রাম্পের বার্তাটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডাও জোন্স, নাসডাক এবং এসঅ্যান্ডপি সূচকে তীব্র ধস নেমে আসে। বৈশ্বিক বাজারগুলোও এই ঘোষণার প্রভাব অনুভব করছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য সম্পর্ক বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের মূল স্তম্ভ। ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন শুল্ক নীতি কার্যকর হলে বৈশ্বিক আমদানি-রপ্তানিতে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দিতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন।
বছরের শুরুতে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে কিছুটা উষ্ণতা ফিরে এসেছিল। কয়েক দফা আলোচনার পর ট্রাম্প আগের আরোপিত উচ্চ শুল্ক কিছুটা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, “চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এখন খুব ভালো অবস্থায় আছে।”
কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই সম্পর্ক আবারও তিক্ত হয়ে উঠছে। চীন যখন মার্কিন প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যবহৃত রেয়ার আর্থ খনিজ রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করল, তখনই ট্রাম্প প্রশাসন বিষয়টিকে ‘অর্থনৈতিক আগ্রাসন’ হিসেবে দেখছে।
নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ ট্রাম্প লিখেছেন, “আমি কখনো ভাবিনি বিষয়টি এ পর্যায়ে পৌঁছাবে। কিন্তু সম্ভবত সময় এসে গেছে। শেষ পর্যন্ত এটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই ভালো হবে।”
তিনি আরও জানান, চীনের ওপর বিদ্যমান শুল্কের ওপর অতিরিক্ত ১০০ শতাংশ নতুন শুল্ক আরোপ করা হবে। এই শুল্ক কার্যকর হবে আগামী ১ নভেম্বর থেকে, কিংবা চীন যদি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়, তবে তার আগেই।
ট্রাম্প আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন ‘সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি’ রপ্তানির ওপরও নতুন করে নিয়ন্ত্রণ আরোপের পরিকল্পনা করছে।
এই ঘোষণার ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান অর্থনৈতিক সংলাপ কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় আসন্ন সম্মেলনের সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে তার পরিকল্পিত বৈঠকটি এখন বাতিল হতে পারে।
তিনি বলেছেন, “চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার এখন কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। যখন তারা যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পে সরাসরি আঘাত হানে, তখন আলোচনা অর্থহীন।”
মাত্র চার মাস আগেও ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্ককে “অসাধারণ” বলেছিলেন। তখন তিনি এক শুল্ক হ্রাস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন, যা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নের নতুন অধ্যায় বলে বিবেচিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সেই অধ্যায় আবারও বন্ধ হতে বসেছে।
এই বছরের শুরুর দিকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়লে ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। জবাবে বেইজিংও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিল। নতুন ঘোষণার ফলে বাণিজ্যযুদ্ধের এই আগুন আরও উসকে উঠবে বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে অর্থনীতিবিদদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, যদি ট্রাম্প তার ঘোষণার সব ধারা কার্যকর করেন, তাহলে শুধু চীন নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারাও বড় ধাক্কা খাবে। কারণ চীনে উৎপাদিত কম্পিউটার, ইলেকট্রনিকস, পোশাক ও গাড়ির যন্ত্রাংশের দাম হু-হু করে বেড়ে যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “ট্রাম্পের শুল্কনীতি হয়তো রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় হতে পারে, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলবে।”
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপান ইতোমধ্যে উদ্বেগ জানিয়েছে। ব্রাসেলসের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বাণিজ্যিক বিরোধ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত, একতরফা শুল্ক আরোপের মাধ্যমে নয়।”
চীন এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পের ঘোষণার প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে বেইজিংয়ের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘অযৌক্তিক শুল্ক নীতি’র জবাবে যথাযথ পাল্টা ব্যবস্থা নেব।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ