
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আওতাধীন নবগঠিত আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট দেশের রাজস্ব ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। মাত্র এক বছরের কার্যক্রমে ইউনিটটি উদ্ঘাটন করেছে অসংখ্য জটিল আয়কর ফাঁকি, যার মধ্যে রয়েছে প্রভাবশালী বহুজাতিক কোম্পানি, বড় শিল্পগোষ্ঠী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি ক্রীড়াঙ্গনের জনপ্রিয় তারকারাও। এসব তদন্তের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ইতোমধ্যে আদায় হয়েছে ২০০ কোটি টাকারও বেশি ফাঁকিকৃত আয়কর—যা এনবিআরের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) এই অর্জনের খবর আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেন ইউনিটের কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রকিব। বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁও ডাক ভবনে অবস্থিত ইউনিটের কার্যালয়ে এক অনাড়ম্বর আয়োজনে এই সাফল্য উদযাপন করা হয়। উপস্থিত ছিলেন ইউনিটের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এনবিআরের প্রতিনিধিরা এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা।
২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট। শুরুতে এটি ছিল এনবিআরের একটি পাইলট প্রকল্প, যার উদ্দেশ্য ছিল — দীর্ঘদিন অনিষ্পন্ন থাকা জটিল ও প্রভাবশালী কর ফাঁকি মামলাগুলোর তদন্ত করা এবং প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্লেষণের মাধ্যমে আয়কর ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ করা।
কিন্তু মাত্র নয় মাসের মধ্যেই ইউনিটটি দেশের রাজস্ব খাতে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রকিব বলেন, “আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ কৃপায় আমরা আজ ২০০ কোটি টাকার ফাঁকিকৃত কর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে পেরেছি। এটি কেবল সংখ্যাগত সাফল্য নয়, এটি আমাদের দায়িত্ববোধ ও পেশাগত সততার প্রতীক।”
তিনি জানান, ২০২৫ সালের ৮ জানুয়ারি ইউনিটের প্রথম ‘এ-চালান’ (অর্থাৎ সরকারি কোষাগারে অর্থ জমার সরকারি চালান) সম্পন্ন হয়। সেই থেকে ৯ মাস ৮ দিনেই তারা ২০১ কোটি ৮২ লাখ ৭৩ হাজার ৪৭১ টাকা ফাঁকিকৃত কর পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন।
সূত্র জানায়, ইউনিটটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কর ফাঁকির বিভিন্ন ধরণ ও প্যাটার্ন শনাক্ত করতে ডিজিটাল টুলস, ডেটা অ্যানালিটিকস ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-ভিত্তিক সফটওয়্যার ব্যবহার শুরু করে।
তাদের তদন্তের আওতায় এসেছে—
বহুজাতিক কোম্পানির ট্রান্সফার প্রাইসিং অনিয়ম,
বড় শিল্পগোষ্ঠীর করপোরেট ট্যাক্স জালিয়াতি,
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঘোষণাবহির্ভূত সম্পদ,
জনপ্রিয় ক্রীড়াবিদ ও বিনোদন জগতের তারকাদের অঘোষিত আয়,
এমনকি অনলাইন ব্যবসা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে লুকানো আয় সংক্রান্ত তদন্তও।
প্রথম কয়েক মাসেই ইউনিটটি প্রায় ৩০০টি পৃথক তদন্ত শুরু করে, যার মধ্যে ৮৫টিরও বেশি মামলার প্রাথমিক নিষ্পত্তি হয়েছে এবং বাকিগুলো বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।
মাইলফলক অর্জন করায় রাজধানীর আগারগাঁও ডাক ভবনে অবস্থিত আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটে কেক কেটে তা উদযাপন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, আয়কর গোয়েন্দা ইউনিটের সফলতা কর প্রশাসনের দীর্ঘদিনের দুর্বলতা কাটাতে বড় ভূমিকা রাখবে। অতীতে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয়কর ফাঁকি সংক্রান্ত ফাইল প্রশাসনিক জটিলতায় আটকে থাকত।
কিন্তু এই ইউনিট সরাসরি “ইনডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেটরি অথরিটি” হিসেবে কাজ করায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
একজন ঊর্ধ্বতন কর কর্মকর্তা বলেন, “আগে কর ফাঁকি উদ্ঘাটনের পর মামলা বা আদায় প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা থাকত। এখন নতুন ইউনিটের মাধ্যমে তদন্ত, মূল্যায়ন ও আদায়—সবকিছু একই ছাতার নিচে হচ্ছে।”
কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রকিব, যিনি এর আগে এনবিআরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, নতুন ইউনিটের প্রতিষ্ঠা পর্যায়ে ছিলেন অন্যতম স্থপতি। তার নেতৃত্বেই ইউনিটটি গত এক বছরে দ্রুতগতি অর্জন করেছে।
তিনি বলেন, “আমরা শুধু ফাঁকি উদ্ঘাটন করছি না, আমরা করদাতার আস্থা ফিরিয়ে আনার কাজ করছি। কর ফাঁকি বন্ধ হলে সবার জন্য করের বোঝা কমে যাবে, দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।”
তিনি আরও বলেন, “মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, অর্থ উপদেষ্টা এবং এনবিআর চেয়ারম্যানের সার্বিক দিকনির্দেশনা ছাড়া এ অর্জন সম্ভব হতো না। আমরা তাঁদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”
ইউনিটের একজন সহকারী কমিশনার জানান, ইতোমধ্যে কয়েকটি বড় কর্পোরেট হাউস ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে কর ফাঁকির দায় স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরা কর পরিশোধ করেছে, ফলে দীর্ঘ মামলা ছাড়াই রাজস্ব আদায় সম্ভব হয়েছে।
ক্রীড়াঙ্গনের কয়েকজন জনপ্রিয় মুখকেও ইউনিটের তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানা গেছে, বিশেষত তারা বিদেশি লিগে খেলে যে আয় করেছেন, তার সঠিক ঘোষণা না দেওয়ার অভিযোগে।
নতুন ইউনিটের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ডিজিটাল গোয়েন্দা নজরদারি ব্যবস্থা। এনবিআরের সার্ভার, ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক, বিআরটিএ, ভূমি রেজিস্ট্রি ও এনআইডি ডেটাবেসের সঙ্গে সংযুক্ত এই সিস্টেমের মাধ্যমে করদাতার প্রকৃত আয় ও সম্পদের মধ্যে অমিল খুঁজে বের করা হয়।
একজন কর্মকর্তা বলেন, “আগে কাগজপত্রের ওপর নির্ভর করতাম, এখন ডেটা বলছে—কে কোথায় কত আয় করছে। আমরা ডিজিটাল ট্রেইল ব্যবহার করে কর ফাঁকি শনাক্ত করছি।”
বৃহস্পতিবারের অনুষ্ঠানে কেক কেটে সাফল্য উদযাপনের সময় কর্মকর্তারা উৎসাহভরে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও জানান। তাদের লক্ষ্য—আগামী অর্থবছরের মধ্যে ৫০০ কোটি টাকার কর ফাঁকি পুনরুদ্ধার করা।
এছাড়া ইউনিটটি আগামী বছর থেকে প্রতিটি কর অঞ্চলে ‘রিজিওনাল ইনভেস্টিগেশন সেল’ গঠন করবে, যাতে জেলা পর্যায়ে কর ফাঁকি ধরা সম্ভব হয়।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বলেন, “এনবিআরের ইতিহাসে এত স্বল্প সময়ে এমন সাফল্য নজিরবিহীন। যদি এই ইউনিট রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে কাজ চালিয়ে যেতে পারে, তাহলে রাজস্ব আদায়ের চিত্র বদলে যাবে।”
সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ মনে করেন, “এটি দেখিয়েছে—সঠিক দিকনির্দেশনা, প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতার সমন্বয় ঘটালে বাংলাদেশেও রাজস্ব সংগ্রহে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।”
মাত্র এক বছরে ২০০ কোটি টাকার ফাঁকিকৃত কর পুনরুদ্ধার শুধু একটি প্রশাসনিক সাফল্য নয়—এটি রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা এবং আর্থিক ন্যায্যতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত।
যে ইউনিটটি ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নিঃশব্দে সূচনা করেছিল, আজ সেটি রাজস্ব ব্যবস্থার অন্যতম আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
দেশের উন্নয়ন ও স্বচ্ছতার অভিযানে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের এই সাফল্য নিঃসন্দেহে এক নতুন মাইলফলক, যা ভবিষ্যতে আরও বড় রাজস্ব সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ