
ছবি: সংগৃহীত
ঐতিহাসিক ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষরের দিনটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে এক করুণ দৃশ্য—একজন তরুণ জুলাই যোদ্ধার ভাঙা কৃত্রিম হাত পড়ে থাকা রাস্তায়।
এক সময় জুলাই আন্দোলনে প্রকৃত হাত হারানো সেই তরুণ আতিকুল ইসলাম এবার হারিয়েছেন তার কৃত্রিম হাতটিও—যা তিনি পুলিশের লাঠিচার্জ থেকে বাঁচতে পালানোর সময় ভেঙে পড়ে রাস্তায় ফেলে আসেন। এই একটি ছবি, একটি ভিডিওই মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
শুক্রবার সকালে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় রাষ্ট্রীয় আয়োজনে জুলাই সনদ স্বাক্ষরের প্রস্তুতি চলছিল। এতে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি, বিদেশি কূটনীতিকসহ হাজারো অতিথি।
কিন্তু একই সময়ে সংসদ ভবনের বাইরে শতাধিক ‘জুলাই যোদ্ধা’ ও তাদের পরিবার সদস্যরা অবস্থান নেন। তারা দাবি জানাচ্ছিলেন—‘জুলাই আন্দোলনে আহত ছাত্র-জনতাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া’ এবং ‘জুলাই আহত বীর’ হিসেবে সম্মাননা অন্তর্ভুক্ত করার। দাবি আদায়ের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচি হঠাৎই উত্তেজনায় রূপ নেয় যখন পুলিশের একাংশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ শুরু করে।
চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দৃশ্য বর্ণনা করেছেন উপস্থিত এক স্বেচ্ছাসেবক, “পুলিশ হঠাৎই এগিয়ে এসে তাড়া করতে থাকে। সবাই ছুটে পালাচ্ছিল। তখন দেখি এক তরুণ পড়ে গেছেন, তার একটা কৃত্রিম হাত রাস্তার মধ্যে পড়ে আছে। পরে জানতে পারি, উনি আতিকুল গাজী, জুলাই যোদ্ধা।”
আতিকুল ইসলাম (আতিকুল গাজী) সেই তরুণ, যিনি জুলাই অভ্যুত্থানের সময় এক দফা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিজের বাম হাত হারিয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি নিয়ে তিনি নিয়মিত আন্দোলনে অংশ নেন।
গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আতিক বলেন, “আমার একটাই হাত নাই, ওটার জায়গায় একটা কৃত্রিম হাত। আজ পুলিশ সেটা ভেঙে দিয়েছে। আমার কাছে কি এমন টাকা আছে, যে আরেকটা বানাবো? ওরা জানে না, একটা আর্টিফিশিয়াল হাত মানে শুধু একটা প্লাস্টিক নয়—ওটা আমার বেঁচে থাকার সহায়ক।”
তিনি আরও বলেন, “এই রাষ্ট্রের জন্য, এই দেশের জন্য আমরা জীবন দিয়েছি, রক্ত দিয়েছি। আজ সেই রাষ্ট্রই আমাদের মারে, আমাদের অপমান করে। এটা কি স্বাধীন রাষ্ট্রের কাজ?”
ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। এক ভিডিওতে দেখা যায়, পুলিশের লাঠিচার্জের মধ্যে এক প্রতিবাদকারী মাটিতে পড়ে আছেন, তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি কৃত্রিম হাত রাস্তার ধারে পড়ে আছে।
এই দৃশ্য ভাইরাল হওয়ার পর ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আতিকুলের প্রতি সহানুভূতি ও পুলিশের প্রতি ক্ষোভে ফেটে পড়েন নেটিজেনরা।
গণমাধ্যমকর্মী কেফায়েত শাকিল লিখেছেন, “এরপর দেশের জন্য হাত লাগলে নিজের হাত নিয়ে এগিয়ে আসতে একশ’ বার ভাববে তরুণরা। আতিকের হাত ভেঙে শুধু প্লাস্টিক নয়, একটা প্রজন্মের বিশ্বাসও ভেঙে গেছে।”
আরেক সাংবাদিক আজহার লেমন লিখেছেন, “জুলাই ভেঙে পড়ে রইল রাস্তায়, অথচ সনদ সাক্ষরের কত আয়োজন! এই দৃশ্য লজ্জার, বেদনাদায়ক এবং রাষ্ট্রের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করে।”
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এক বিবৃতিতে বলেছে, “রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের দিন এমন সহিংসতা অনভিপ্রেত। যাদের ত্যাগের ইতিহাসের ওপর দাঁড়িয়ে জুলাই সনদ রচিত, তাদের ওপর হামলা দেশের নৈতিক ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।”
অপরদিকে সমাজবিজ্ঞানী ড. নাসিমা রহমান মনে করেন, “এই ঘটনাটি শুধুই পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ নয়, বরং এটি প্রতীকীভাবে রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের আস্থা নষ্ট করছে। যারা ত্যাগ করেছে, তারা আজ নিজ দেশের রাস্তায় অপমানিত হচ্ছে—এটা ভয়াবহ বার্তা।”
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবিগুলোতে দেখা যায়, আতিকের ভাঙা কৃত্রিম হাতটি রাস্তায় পড়ে আছে, আর চারপাশে ছুটছে বিক্ষুব্ধ তরুণরা। এই দৃশ্যকে ঘিরে ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন—#জুলাইযোদ্ধার_রক্ত, #আতিকের_হাত, #রাষ্ট্র_জবাব_দাও ইত্যাদি।
একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “১৯৭১-এ মুক্তিযোদ্ধারা যেমন বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলেন, জুলাই যোদ্ধারাও যেন সেই পরিণতির মুখে।”
আরেকজন লিখেছেন, “যারা জুলাইতে জীবন বাজি রেখে দেশের ভবিষ্যৎ বদলে দিয়েছিল, আজ তাদের ওপর লাঠি চালিয়ে রাষ্ট্র প্রমাণ করলো—ইতিহাসের ঋণ আমরা ভুলে গেছি।”
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অন্তত ১০ জন জুলাই যোদ্ধা চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। হাসপাতালের পরিচালক জানিয়েছেন, “বেশ কয়েকজনের মাথা ও পায়ে গুরুতর আঘাত রয়েছে। পুলিশি হামলার বিষয়টি আমরা যাচাই করছি।”
অন্যদিকে, পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাথমিকভাবে জানানো হয়, ঘটনাটি “দুর্ভাগ্যজনক” হলেও বিক্ষোভকারীরা প্রথমে পুলিশের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছিল বলে দাবি করা হয়েছে। তবে এ বক্তব্যের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ মূলত জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক রূপান্তরের ঐতিহাসিক দলিল, যেখানে নতুন প্রজন্মের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু জুলাই যোদ্ধাদের অভিযোগ, সনদে তাদের দাবিগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তাদের প্রধান দাবি ছিল—
১️⃣ জুলাই আন্দোলনে আহত ছাত্র-জনতাকে “জুলাই আহত বীর” হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া,
২️⃣ আহত ও নিহতদের পরিবারকে আইনি সুরক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান,
৩️⃣ সনদে এসব বিষয় দ্রুত অন্তর্ভুক্ত করে কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
এসব দাবি উপেক্ষিত হওয়াতেই তারা সনদ স্বাক্ষরের দিন প্রতিবাদে অংশ নেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই আন্দোলন দেশের ইতিহাসে যেমন প্রতীকী বিপ্লব, তেমনি এটি তরুণ প্রজন্মের আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি। সেই আন্দোলনের সৈনিকদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অবহেলা নতুন প্রজন্মের রাজনীতি ও দেশপ্রেমে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে।
লেখক হুমায়ুন কবীর মন্তব্য করেছেন, “আতিকের ভাঙা হাত আসলে রাষ্ট্রের মুখোশ উন্মোচন করেছে। যেদিন বীরেরা অপমানিত হয়, সেদিন ইতিহাস নতুন করে হিসাব রাখে।”
জুলাই সনদ ছিল জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা পরিণত হলো বিভেদের প্রতীকীতে। একদিকে উজ্জ্বল মঞ্চে সনদ স্বাক্ষরের আয়োজন, অন্যদিকে বাইরে রক্তাক্ত তরুণরা—এই দুই চিত্র যেন আজকের রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার নির্মম প্রতিফলন।
যে তরুণ একসময় নিজের হাত হারিয়ে দেশের জন্য লড়েছিলেন, সেই আতিক আজ আরেকবার হাত হারিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন—“এই রাষ্ট্র কার?”
রাষ্ট্রের এই প্রশ্নের উত্তর না মিললে আতিকের মতো আরও অনেক তরুণ হয়তো ভবিষ্যতে দেশের জন্য হাত বাড়ানোর আগে সত্যিই ‘একশো বার’ ভাববে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ