
ছবি: সংগৃহীত
পাকিস্তানের সঙ্গে সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনা এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরও নতুন করে সহিংসতা দেখা দিয়েছে আফগানিস্তানে। শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) গভীর রাতে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে একাধিক স্থানে বোমা বর্ষণ করে। ভয়াবহ এই হামলায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে তিনজন স্থানীয় ক্রিকেটারও ছিলেন। এ মর্মান্তিক ঘটনায় শোকাহত আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি) ঘোষণা দিয়েছে—তারা পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে নির্ধারিত নভেম্বরের ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে আর অংশ নেবে না।
ইএসপিএন এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে জানা যায়, নিহত তিনজন ক্রিকেটার পাকতিকা প্রদেশের রাজধানী শারানার বাসিন্দা ছিলেন। তারা শুক্রবার বিকেলে একটি স্থানীয় ‘ফ্রেন্ডলি’ ম্যাচে অংশ নিয়ে রাতে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি ফেরার পথে বিমান হামলার কবলে পড়েন। পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান সীমান্তবর্তী এলাকা লক্ষ্য করে একাধিক রকেট ও বোমা নিক্ষেপ করলে তাদের গাড়িটি আগুনে পুড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই তারা প্রাণ হারান।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, হামলায় নিহতদের মধ্যে দুইজন আফগানিস্তানের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলতেন এবং প্রাদেশিক ক্রিকেট একাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা সম্প্রতি জাতীয় অনূর্ধ্ব-২৩ দলে নির্বাচনের প্রাথমিক তালিকায়ও ছিলেন। নিহত অন্যজন স্থানীয় ক্রিকেট ক্লাবের অধিনায়ক ছিলেন।
ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স (পূর্বের টুইটার)-এ এক বিবৃতি দিয়ে আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড জানিয়েছে, “পাকিস্তানের পরিচালিত এ হামলায় আমাদের তিনজন প্রতিশ্রুতিশীল ক্রিকেটার প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মৃত্যু আমাদের ক্রীড়া সম্প্রদায়ের জন্য অপরিমেয় ক্ষতি। এ ঘটনায় আমরা গভীর শোকাহত এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “মানবিক ও নৈতিক অবস্থান থেকে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে নির্ধারিত ত্রিদেশীয় সিরিজে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের ক্রিকেটারদের রক্ত ঝরার পর মাঠে নামা অসম্ভব।”
আগামী ১৭ থেকে ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি ও লাহোরে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজ। পাকিস্তানের মাটিতে আফগানিস্তানের এটি হতে যাচ্ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক সিরিজ, যা দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতির প্রতীক হিসেবেও দেখা হচ্ছিল। কিন্তু হামলার ঘটনায় সিরিজটি এখন কার্যত অনিশ্চিত।
আফগানিস্তানের প্রত্যাহারের পর পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে পিসিবির এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ‘ডন’ জানিয়েছে, বোর্ড ঘটনাটিকে ‘রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে’ পর্যবেক্ষণ করছে এবং কূটনৈতিক দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সীমান্তে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। উভয় দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় ও সহযোগিতা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। পাকিস্তান দাবি করছে, আফগানিস্তানের ভেতর থেকে পাকিস্তানবিরোধী জঙ্গিগোষ্ঠী ‘তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান’ (টিটিপি) তাদের ভূখণ্ডে হামলা চালাচ্ছে। অন্যদিকে, আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তী সরকার বলছে, পাকিস্তান সীমান্ত অজুহাতে তাদের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করছে এবং সাধারণ জনগণের ওপর নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছে।
শুধু গত দুই সপ্তাহেই পাকিস্তানের বিমান হামলায় আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এসব হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধবিরতি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে।
এদিকে, দুই দেশের সম্পর্ক উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় কাতারের রাজধানী দোহায় আগামী সপ্তাহে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, কাতার এ বৈঠকে মধ্যস্থতা করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রও পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারে। তবে বিমান হামলার সর্বশেষ ঘটনায় বৈঠকটি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর সব সময়ই রাজনৈতিক সংবেদনশীলতার মধ্যে পড়ে। ২০২৩ সালের এশিয়া কাপে এবং এ বছরের শুরুতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সময় আফগানিস্তান পাকিস্তানে গিয়েছিল, তবে সেখানে তারা সরাসরি পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনো ম্যাচ খেলেনি। এর আগে ২০২১ সালে তালেবান সরকার ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে আফগান ক্রিকেটারদের ওপর আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল।
অন্যদিকে, পাকিস্তানও প্রায়ই অভিযোগ করে আসছে যে আফগান ক্রিকেট বোর্ডে তালেবানপন্থী কর্মকর্তারা প্রভাব বিস্তার করছেন এবং ক্রীড়াঙ্গনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন। এবারের ঘটনায় দুই দেশের ক্রিকেট সম্পর্ক আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জাতিসংঘের আফগান মিশন (ইউএনএএমএ) এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের বিমান হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, “যেকোনো রকম সীমান্ত লঙ্ঘন এবং বেসামরিক হতাহতের ঘটনা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের পরিপন্থী। আমরা অবিলম্বে পরিস্থিতি শান্ত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।”
এদিকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) বলেছে, “এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক ঘটনা। আমরা আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছি এবং ক্রিকেটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিচ্ছি।”
নিহত তিন ক্রিকেটারের মৃত্যুর খবরে আফগানিস্তানের ক্রীড়া অঙ্গনে নেমে এসেছে গভীর শোক। কাবুল, কান্দাহার, হেরাতসহ বিভিন্ন শহরে তাদের স্মরণে প্রার্থনা ও মোমবাতি প্রজ্বলন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রাক্তন অধিনায়ক মোহাম্মদ নবী এক্সে লিখেছেন, “তারা শুধু ক্রিকেটার ছিলেন না, তারা আমাদের স্বপ্নের প্রতীক ছিলেন। যুদ্ধের নামে নিরীহ প্রাণহানি বন্ধ হোক।”
পাকিস্তানের বিমান হামলায় তিন তরুণ আফগান ক্রিকেটারের মৃত্যু শুধু দুই দেশের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকেই নয়, ক্রীড়াজগতকেও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে উত্তেজনায় থাকা ইসলামাবাদ ও কাবুলের সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে যেখানে ক্রিকেট শান্তি ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো, সেখানে আবারও রক্ত ঝরল—যা পুরো জাতির হৃদয় বিদীর্ণ করে দিয়েছে।
সূত্র: ইএসপিএন, ডন, টোলোনিউজ, আল জাজিরা
বাংলাবার্তা/এমএইচ