
ছবি: সংগৃহীত
দেশের সবজির বাজারে ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কৃষক, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের উদ্বেগ দিন দিন বাড়ছে। কৃষক থেকে রাজধানীর খুচরা বাজারে পৌঁছতে গিয়ে সবজির দাম প্রায় চার গুণ বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘন ঘন হাতবদল, চাঁদাবাজি, মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট ও বাজার তদারকির দুর্বলতা এই বিশাল দামপার্থক্যের মূল কারণ। ফলে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না, আর সাধারণ ভোক্তাদের বাধ্য হয়ে বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
দেশের অন্যতম বড় সবজির মোকাম বগুড়ার মহাস্থান হাটে কৃষকরা বেগুন মানভেদে ২৭ থেকে ৪০ টাকা কেজি এবং শিম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন। অথচ রাজধানীর খুচরা বাজারে একই সবজি চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীর বাজারে এখন বেগুন ১০০ থেকে ১৮০ টাকা কেজি, শিম ১৬০ থেকে ২০০ টাকা কেজি এবং করলা ১০০ থেকে ১২০ টাকা। বরবটি, পটোল, ঝিঙা, ঢেঁড়স, মিষ্টিকুমড়া ও লম্বা লাউও কৃষকের বিক্রির দামের তিন থেকে চার গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর ক্রেতারা শীতের আগাম সবজির চড়া দামে ক্রয় করতে গিয়ে তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না। কিছু দিন আগেও যে সবজি ৭০ থেকে ৮০ টাকায় মিলত, এখন তা ১২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। বাজারে ক্রেতাদের অভিযোগ, “শুধু দামই নয়, বাজারে স্বল্প সরবরাহ ও একাধিক হাতবদলের কারণে এক ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে, যা আমাদের আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”
কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. হাবিব বলেন, “কৃষকরা প্রথমে স্থানীয় বাজারে সবজি নিয়ে আসেন। স্থানীয় বাজারে ফড়িয়া বা পাইকারদের সিন্ডিকেট থাকে। তারা নির্দিষ্ট দামে কৃষক থেকে কিনে নেন। পরে ট্রাক বা পিকআপে রাজধানীতে আসা সবজিও কয়েকটি হাতবদল হয়ে খুচরা বাজারে বিক্রি হয়। মূলত এই হাতবদল ও সিন্ডিকেটের কারণে দাম চার গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়।”
মহাস্থান হাটের কৃষক শহীদুল ইসলাম বলেন, “বৃষ্টির কারণে এ বছর উৎপাদন কমেছে। আমরা ন্যায্য দাম পাচ্ছি না। এত খরচ করে আমাদের ফসল বিক্রি না হলে সংসার চালানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মধ্যস্বত্বভোগীরা কৃষকের পণ্যের ন্যায্য মূল্যের অর্ধেকও দিতে চায় না, কিন্তু শহরের বাজারে একই পণ্য অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি হয়। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, “বাজারব্যবস্থার এই কাঠামোগত দুর্বলতা কৃষক ও ভোক্তাকে একসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যদি সরাসরি কৃষক থেকে বিক্রেতা ও ভোক্তার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়, তাহলে দাম বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসবে।”
বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দিন ফিরোজ জানান, “কৃষি বিপণন ব্যবস্থাকে অনলাইন ও অফলাইন দু’দিক থেকে শক্তিশালী করতে হবে। প্রান্তিক কৃষকরা প্রায় সব সময় বঞ্চিত হচ্ছেন। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা এবং বাজার ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করা।”
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে কাজ করা ভলান্টারি কনজিউমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটি-এর নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল বলেন, “বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় কৃষকও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এবং ভোক্তাও অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে পণ্য কিনতে বাধ্য। মূল সমস্যা হলো মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, যারা আড়াই থেকে তিন গুণ পর্যন্ত লাভ করেন।”
তিনি আরও বলেন, “কৃষকের পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছালে কৃষক ন্যায্য দাম পাবে এবং ভোক্তারাও চড়া দাম এড়াতে পারবে। বাজারের প্রতিটি ধাপে মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ থাকলে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব।”
-
বগুড়া মহাস্থান হাট: বেগুন ২৭–৪০ টাকা, শিম ৩৫–৪০ টাকা, করলা ৩২–৩৮ টাকা, বরবটি ৩০–৩২ টাকা, পটোল ২০–২৫ টাকা, ঝিঙা ৩০–৩৬ টাকা, ঢেঁড়স ২০–২৫ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ১৭–২০ টাকা, লম্বা লাউ ১৫–২৫ টাকা।
-
রাজধানীর খুচরা বাজার: বেগুন ১০০–১৮০ টাকা, শিম ১৬০–২০০ টাকা, করলা ১০০–১২০ টাকা, বরবটি ১০০–১২০ টাকা, পটোল ৭০–৮০ টাকা, ঝিঙা ৯০–১০০ টাকা, ঢেঁড়স ৮০–১০০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৫৫–৬০ টাকা, লম্বা লাউ ৭০–৮০ টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হাতবদল, মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট এবং বাজার কাঠামোর দুর্বলতা মূলত এই দামপার্থক্যের জন্য দায়ী। কৃষি বিপণন ব্যবস্থার সংস্কার ও সরাসরি কৃষক-ভোক্তা যোগাযোগ নিশ্চিত করা হলে, কৃষক ন্যায্য মূল্য পাবে এবং ভোক্তারাও চড়া দামে সবজি কিনতে বাধ্য হবে না। দেশের কৃষি বাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বাজার ব্যবস্থার সতর্ক ও পরিকল্পিত পুনর্গঠন অপরিহার্য।
বাংলাবার্তা/এমএইচ