
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দর চলতি অর্থবছরের শুরুতেই এক ঐতিহাসিক সাফল্যের সাক্ষী হয়েছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বন্দরের প্রায় সব সূচকে অর্জিত হয়েছে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধজনিত পরিবহন সংকট, এবং জ্বালানি ব্যয়ের চাপ থাকা সত্ত্বেও দেশের এই প্রধান সমুদ্রবন্দরটি ধারাবাহিকভাবে কার্যক্রম চালিয়ে গিয়ে দক্ষতা, আধুনিকায়ন ও অপারেশনাল সক্ষমতায় নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মোট ৯ লাখ ২৭ হাজার ৭১৩ টিইইউস (২০ ফুট সমপরিমাণ কনটেইনার) হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ২৬ হাজার ৫২৮ টিইইউস। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ১ লাখ ১ হাজার ১৮৫ টিইইউস, যা প্রবৃদ্ধির হারে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ২৪ শতাংশ—বন্দর ইতিহাসে অন্যতম উচ্চ প্রবৃদ্ধি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কনটেইনার হ্যান্ডলিং বৃদ্ধির এই প্রবণতা দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের পুনরুদ্ধার এবং বন্দর ব্যবস্থাপনার উন্নত দক্ষতার প্রতিফলন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
একই সময়ে বন্দরে মোট ৩ কোটি ২৯ লাখ ১৯ হাজার ৯৬৬ টন কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ বেশি। এই বিশাল কার্গো প্রবাহের মধ্যে রয়েছে পণ্য আমদানি, কাঁচামাল, শিল্প উপকরণ, কৃষিপণ্য ও বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যের চালান।
বন্দর কর্মকর্তারা জানান, বন্দর জেটির সম্প্রসারণ, ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু এবং পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি প্রবর্তনের কারণে কাজের গতি বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট ১ হাজার ৩১টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি।
এই প্রবৃদ্ধি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বন্দরটিতে এখন জাহাজ আগমন ও প্রস্থানের কার্যক্রম আরও দ্রুত ও দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন হচ্ছে। অতীতে যেখানে জাহাজকে দীর্ঘসময় নোঙরে অপেক্ষা করতে হতো, এখন সে সময় কমে এসেছে গড়ে ২ দিন পর্যন্ত।
চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম আধুনিক অবকাঠামো নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এবারও ছিল প্রবৃদ্ধির শীর্ষে।
জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে এনসিটিতে হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৪৯ টিইইউস কনটেইনার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪১ হাজার ৭৫৪ টিইইউস বেশি। এতে প্রবৃদ্ধির হার ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
একই সময়ে এনসিটিতে ১৭৮টি জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২৬টি বেশি। বন্দর কর্তৃপক্ষের মতে, এটি এনসিটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ অর্জন।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উন্নত কনটেইনার মুভমেন্ট সিস্টেম, স্বয়ংক্রিয় ক্রেন পরিচালনা এবং অভিজ্ঞ কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণই এই প্রবৃদ্ধির মূল কারণ।
শুধু তিন মাস নয়, পুরো বছরের প্রথম নয় মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২৫) চিত্রও ইতিবাচক। এই সময়ে বন্দরে মোট ২৫ লাখ ৬৩ হাজার ৪৫০ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১ লাখ ২১ হাজার ৬২৫ টিইইউস বেশি। এতে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
এ সময় বন্দরে মোট ১০ কোটি ২৭ লাখ ৪ হাজার ২৫৯ টন কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে—যা গত বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ বেশি। একই সময়ে ৩ হাজার ১৬১টি জাহাজ বন্দরে এসেছে ও ছেড়ে গেছে, যেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
বিশ্বব্যাপী চলমান যুদ্ধ, ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েন, পরিবহন ধর্মঘট এবং আন্তর্জাতিক শিপিং সংকট সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমে তেমন কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সি অ্যান্ড এফ) এজেন্ট মেসার্স ফাল্গুনী ট্রেডার্স লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইসমাইল খান বলেন— “বিশ্বজুড়ে নানা অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে রেড সি রুটে যুদ্ধ, জ্বালানি দামের অস্থিরতা, এবং ইউরোপীয় পরিবহন ধর্মঘটের কারণে অনেক দেশের বন্দর কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও আগাম পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলাতে পেরেছে।”
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত দুই বছরে বন্দরের কর্মপরিধি ও অবকাঠামো উন্নয়নে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ এখন বাস্তব সুফল দিচ্ছে।
বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন— “চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। জাতীয় রাজস্বের বড় অংশ আসে এখান থেকেই। আমাদের মূল লক্ষ্য বন্দরের আধুনিকায়ন, জাহাজের অবস্থানকাল কমানো, ইয়ার্ড ও জেটি সুবিধা সম্প্রসারণ এবং নিরাপদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।”
তিনি আরও বলেন, বন্দরের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, অনলাইন কাস্টমস প্রসেসিং এবং কনটেইনার ট্র্যাকিং সিস্টেমকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে, যাতে বাণিজ্যিক লেনদেন আরও দ্রুত হয়।
বন্দর কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এর মধ্যে রয়েছে—
পাটুরিয়া টার্মিনাল সম্প্রসারণ প্রকল্প,
বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প,
বন্দর ইয়ার্ডের ক্ষমতা দ্বিগুণ করা,
নতুন কনটেইনার স্ক্যানার ও ক্রেন সংযোজন,
ডিজিটাল টিকিটিং ও ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু।
এই সব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ৪০ লাখ টিইইউস ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম সক্ষমতা হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের এই প্রবৃদ্ধি দেশের রপ্তানি আয়, আমদানি কার্যক্রম এবং রাজস্ব আদায়ে সরাসরি ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বন্দরের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ড. নাজমুল ইসলাম বলেন— “বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় ৯০ শতাংশ বাণিজ্য কার্যক্রম চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। এখানে দক্ষতা বাড়লে তা সরাসরি দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে প্রতিফলিত হয়।”
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এখন কাজ করছে ‘স্মার্ট পোর্ট মডেল’ বাস্তবায়নের দিকে। এর আওতায় সব ধরনের ডকুমেন্টেশন ডিজিটাল হবে, জাহাজের আগমন ও প্রস্থান সম্পূর্ণ অটোমেটেড পদ্ধতিতে হবে, এবং বন্দরব্যবস্থাপনা হবে রিয়েল-টাইম ডেটা নির্ভর।
সচিব ওমর ফারুক বলেন, “আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা চট্টগ্রাম বন্দরকে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কার্যকর ও স্মার্ট পোর্ট হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক ও জাইকার সহায়তায় প্রকল্প চূড়ান্ত হয়েছে।”
বৈশ্বিক বাণিজ্য অনিশ্চয়তার মধ্যেও চট্টগ্রাম বন্দরের এই ধারাবাহিক সাফল্য বাংলাদেশের জন্য এক ইতিবাচক বার্তা বহন করছে। দেশের অর্থনৈতিক গতি, রাজস্ব আয় ও বাণিজ্যিক আস্থার পুনর্গঠনে এই প্রবৃদ্ধি নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের এই প্রবৃদ্ধি কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়—এটি বাংলাদেশের শিল্পোন্নয়ন, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ