ছবি: সংগৃহীত
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ চৌধুরী বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার এই সময় গণভোট আয়োজনের তাড়াহুড়ো আসলে নির্বাচনের সময়সূচি পেছানোর একটি কৌশল মাত্র। তিনি বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা হচ্ছে, যা ইতিহাস বিকৃতির সামিল।
বুধবার (৮ অক্টোবর) রাতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে সমাপনী বক্তব্যে তিনি এসব মন্তব্য করেন। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর একটি হোটেলে, যেখানে কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু আমি প্রশ্ন করি—এই মুহূর্তে হাতে আছে মাত্র দেড় মাস, এর মধ্যেই এমন বিশাল পরিসরের একটি গণভোট আয়োজন কতটা সম্ভব? গণভোট কোনো ছোটখাটো আয়োজন নয়, এটি জাতীয় নির্বাচনের মতোই প্রশাসনিক, নিরাপত্তা ও লজিস্টিক প্রস্তুতি দাবি করে। এখন গণভোটের উদ্যোগ আসলে আমি সেটিকে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়ার প্রয়াস হিসেবেই দেখি।”
তিনি বলেন, “গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবটি এমন সময়ে এসেছে, যখন নির্বাচন কমিশন আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতিমূলক কার্যক্রম শুরু করেছে। এখন হঠাৎ করে গণভোটের কর্মযজ্ঞ শুরু করলে নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করাই প্রশ্নের মুখে পড়বে।”
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রসঙ্গেও সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা জুলাই সনদের মূল ভাবনা ও উদ্দেশ্যের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু এখন যারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করছেন, তারা অনেক সময় মূল ঘোষণার সীমা অতিক্রম করছেন। আমরা ঐকমত্যে এসেছি জুলাই সনদের ব্যাপারে, কিন্তু এর বাস্তবায়নে আমাদের নোট অব ডিসেন্ট (অমতের নোট) স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “জুলাই সনদ নিয়ে যেভাবে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, সেটিই বজায় থাকা উচিত। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যদি নতুন ব্যাখ্যা বা রাজনৈতিক পক্ষপাত ঢুকে যায়, তাহলে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হবে। আমরা চাই, যে অঙ্গীকারনামা তৈরি হবে সেখানে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকুক, যেন জনগণ জানে আমরা কোন বিষয়ে একমত এবং কোন বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করছি।”
সালাহউদ্দিন আহমদ তার বক্তব্যে আরও বলেন, “দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, কিছু মহল জুলাই ঘোষণাপত্রের সঙ্গে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে এক করার চেষ্টা করছে। এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক প্রবণতা। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের অস্তিত্বের ভিত্তি—এর সঙ্গে অন্য কোনো রাজনৈতিক সনদ বা ঘোষণাকে তুলনা করা মানে স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ছোট করে দেখা।”
তিনি অভিযোগ করেন, “জুলাই ঘোষণাপত্রের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক সংস্কারের পথ তৈরি করা, কিন্তু এখন কিছু দল এটিকে নতুন এক ‘মুক্তির ঘোষণা’ হিসেবে উপস্থাপন করছে। এতে করে মুক্তিযুদ্ধের মূল দর্শন বিকৃত হচ্ছে। আমরা এ ধরনের ঐতিহাসিক বিকৃতির তীব্র প্রতিবাদ জানাই।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চলমান আলোচনাকে ইতিবাচক মনে করলেও সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এখন পর্যন্ত কমিশনের আলোচনায় বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত কম, রাজনৈতিক কৌশল বেশি দেখা যাচ্ছে। বিএনপি গণতন্ত্র, নির্বাচনী সংস্কার ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য নিয়ে এই আলোচনায় অংশ নিয়েছে, তা যেন রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে পরাজিত না হয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশাকে ধারণ করি, কিন্তু সেটির নাম করে কেউ যেন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের রায়ই শেষ কথা—এখন সময় তাদের সেই অধিকার প্রয়োগের।”
সালাহউদ্দিন আহমদের এই বক্তব্যের পর রাজনৈতিক মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন, দলের ভেতরে অনেকেই মনে করছেন এখন গণভোট আয়োজনের বাস্তবিক কোনো প্রয়োজন নেই। তারা আশঙ্কা করছেন, এটি নির্বাচনের প্রস্তুতি প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলতে পারে।
অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দল ও তাদের ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব এসেছে জনগণের মতামত জানার উদ্দেশ্যে। তারা মনে করে, জুলাই সনদের ভিত্তিতে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কাঠামো নির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে এমন একটি গণভোট আয়োজন করা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে “ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ”। এতে নির্বাচনের নির্ধারিত সময়সূচি বিলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদের এই বক্তব্য স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত করছে যে, বিএনপি গণভোটের নাম করে জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করার যেকোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে চায়। তার মতে, জনগণের রায় জানার সবচেয়ে সঠিক উপায় হলো সময়মতো সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন—অতিরিক্ত কোনো গণভোট বা নতুন রাজনৈতিক আয়োজন নয়।
তিনি বলেন, “গণতন্ত্রের মূল শক্তি জনগণ। তাদের রায় জানার একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে নির্বাচন—গণভোট নয়। তাই জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে নির্বাচন যেন যথাসময়ে হয়, সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



