ছবি: সংগৃহীত
দখলদার ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির বুধবার (৮ অক্টোবর) সকালে সেনা ও পুলিশ সদস্যদের এক বিশাল বহর নিয়ে মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গনে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি এক উগ্র, উসকানিমূলক ভাষণ দেন—যার মূল বক্তব্য ছিল, “আল-আকসার মালিক এখন ইসরাইল।” তার এই সফর এবং বক্তব্যকে ফিলিস্তিনি ও মুসলিম বিশ্ব নতুন করে চরম উসকানি হিসেবে দেখছে।
বেন-গভিরের এই আগ্রাসী পদক্ষেপ এমন এক সময় ঘটল, যখন মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা তীব্র, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বোমা হামলায় অসংখ্য ফিলিস্তিনি নিহত, এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার জেরুজালেমে স্থিতাবস্থা (status quo) রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছে। তবু এর কোনো তোয়াক্কা না করে বেন-গভির আল-আকসা চত্বরে প্রবেশ করে ইহুদি প্রার্থনা সম্পাদন করেন—যা সরাসরি আন্তর্জাতিক চুক্তি ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন।
ইতামার বেন-গভির শুধু ইসরাইলি সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী নন, বরং চরম ডানপন্থি ওৎসমা ইয়েহুদিত (Jewish Power) দলের নেতা, যিনি দীর্ঘদিন ধরে আল-আকসা মসজিদের জায়গায় “তৃতীয় ইহুদি মন্দির” নির্মাণের পক্ষে সওয়াল করে আসছেন। তার এই সফরকে বিশ্লেষকরা বলছেন “পরিকল্পিত দখলদার কৌশলের অংশ”, যার উদ্দেশ্য হলো—আল-আকসার বর্তমান ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও আইনি অবস্থানকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করে সেখানে ইহুদি উপস্থিতি বৈধ করা।
বেন-গভির বলেন, “এখন থেকে আল-আকসা আমাদের। এটি ইসরাইলি ভূমি, ইহুদি সার্বভৌমত্বের প্রতীক।” তার এমন বক্তব্য শুধু ইসলামি বিশ্বের জন্যই নয়, আন্তর্জাতিক আইনের জন্যও এক চরম চ্যালেঞ্জ।
এই ঘটনার পরপরই মুসলিম বিশ্বে নিন্দার ঝড় ওঠে। সৌদি আরব, জর্ডান, তুরস্ক, ইরানসহ বহু মুসলিম দেশ ইসরাইলের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আল-আকসা চত্বরে দখলদার বাহিনীর নিরাপত্তায় ইসরাইলি কর্মকর্তা ও অবৈধ বসতিস্থাপনকারীদের তাণ্ডবের কঠোর নিন্দা জানাচ্ছে সৌদি আরব। জেরুজালেম এবং পবিত্র স্থানগুলোর ঐতিহাসিক ও আইনি স্থিতাবস্থা পরিবর্তনের যেকোনো প্রয়াস আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছি।”
যদিও সৌদি বিবৃতিতে বেন-গভিরের নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবু তারা সরাসরি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহ্বান জানিয়েছে, “এই পবিত্র স্থান লঙ্ঘনের দায়ে দখলদার ইসরাইলকে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আনতে হবে।”
পাশাপাশি ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষও এক বিবৃতিতে বলেছে, “বেন-গভিরের এই সফর একঘরে হয়ে পড়া ইসরাইলের উগ্র সরকারের নতুন দখলদার বার্তা—যার লক্ষ্য হলো মুসলমানদের পবিত্র স্থানকে অবমাননা করা এবং ভবিষ্যৎ যুদ্ধ উসকে দেওয়া।”
আল-আকসা মসজিদে অমুসলিমদের ধর্মীয় আচার বা প্রার্থনা সম্পাদনের ওপর প্রথম আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা জারি হয় ১৭৫৭ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতানের ফরমানের মাধ্যমে। ঐ ফরমান অনুযায়ী, জেরুজালেমের বিভিন্ন পবিত্র স্থানে প্রতিটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণ করা হয়। এর আওতায় মুসলমানরা আল-আকসায় নামাজ আদায় করবেন, আর ইহুদিরা পাশের ওয়েস্টার্ন ওয়াল (বুরাক দেয়াল) এলাকায় প্রার্থনা করবেন। এই ব্যবস্থাই পরবর্তীতে “স্থিতাবস্থা” নামে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়।
কিন্তু ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেমসহ আল-আকসা প্রাঙ্গন দখল করে নেয়। এরপর ইসরাইল আন্তর্জাতিক চাপের মুখে আল-আকসা মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে বাস্তবে গত কয়েক দশক ধরে ইসরাইলি উগ্রবাদীরা প্রায়ই মসজিদে প্রবেশ করে প্রার্থনা ও রাজনৈতিক প্রদর্শন করছে—যা ক্রমাগতভাবে স্থিতাবস্থা লঙ্ঘন করছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বেন-গভিরের মতো উগ্র নেতাদের এই ধরনের কর্মকাণ্ড শুধু রাজনৈতিক প্রতীকী বার্তা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে ধর্মীয় সংঘাত উসকে দেওয়ার প্রচেষ্টা। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যদি ইসরাইল এভাবে আল-আকসায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যায়, তবে ফিলিস্তিনে নতুন ইন্তিফাদা (জনঅভ্যুত্থান) শুরু হতে পারে।
ফিলিস্তিনি ইসলামিক ওয়াকফ কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র বলেন, “আল-আকসা শুধু একটি মসজিদ নয়, এটি মুসলিম পরিচয়ের প্রতীক। এখানে ইসরাইলি মন্ত্রীদের প্রবেশ এবং প্রার্থনা করা মানে ইসলামি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা।”
যদিও ইসরাইলি সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বেন-গভিরের সফরকে “ব্যক্তিগত উদ্যোগ” হিসেবে ব্যাখ্যা দিয়েছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে এটি আসলে সরকারি নীরব সমর্থনের ফল। কারণ, মন্ত্রী হিসেবে এমন নিরাপত্তা বহর ও অনুমতি ছাড়া আল-আকসা চত্বরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত টর ওয়েনেসল্যান্ড এক বিবৃতিতে বলেন, “জেরুজালেমের পবিত্র স্থানের স্থিতাবস্থা রক্ষা আন্তর্জাতিক আইনের দায়িত্ব। কোনো একতরফা পদক্ষেপ বা উসকানিমূলক আচরণ অঞ্চলজুড়ে সহিংসতা বাড়াতে পারে।”
মক্কা ও মদিনার পর মুসলমানদের কাছে আল-আকসা মসজিদই তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, এখান থেকেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিরাজে গমন করেছিলেন। তাই এটি শুধু একটি স্থাপনা নয়, বরং মুসলিম বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
অন্যদিকে, ইহুদিরা দাবি করে, এই স্থানেই তাদের প্রাচীন টেম্পল অব সলোমন বা সোলায়মান মন্দির ছিল—যা ধ্বংসের পর তারা পুনর্নির্মাণ করতে চায়। এই দুই দাবিই আজকের জেরুজালেমকে বিশ্বের অন্যতম স্পর্শকাতর ধর্মীয় সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে।
আল-আকসায় বেন-গভিরের সর্বশেষ সফর ও “মালিকানা দাবি”কে অনেক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক দেখছেন বৃহত্তর এক দখলদার নীতির প্রতিফলন হিসেবে—যেখানে ইসরাইল ধীরে ধীরে মুসলিম বিশ্বের প্রতীকী শক্তিকেন্দ্রকে নিজেদের সার্বভৌমত্বের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। আর তাই, মুসলিম বিশ্বে এখন প্রশ্ন উঠছে—আল-আকসা কি নতুন সংঘাতের সূচনাবিন্দু হয়ে উঠছে?
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



