ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বিদেশি শ্রমবাজার সম্প্রসারণে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ানো ভিসা জটিলতা নিরসনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিশেষ উদ্যোগ নিতে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। দেশের অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতা ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গঠিত “স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) উত্তরণ জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির” বৈঠকে তিনি এই নির্দেশ দেন। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় গতকাল বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে, যেখানে প্রধান উপদেষ্টা নিজেই সভাপতিত্ব করেন।
বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আমাদের কাছে এটা পরিষ্কার হতে হবে যে আমরা আর পরনির্ভর হতে চাই না। এখনো আমরা অনেক বিষয়ে পরনির্ভর। এই অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব আত্মনির্ভরতার পথে এগোতে হবে।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান রূপান্তরের সময়টিকে সুযোগ হিসেবে নিতে হবে—কারণ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দেশের অবস্থান বদলে যাবে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, “স্বনির্ভর হতে হলে আমাদের অভ্যাস বদলাতে হবে। বুদ্ধি খাটাতে হবে, পরিশ্রম করতে হবে, এবং লড়াই করতে হবে। এটি হয়তো কঠিন, কিন্তু এর মধ্যেই প্রকৃত আনন্দ রয়েছে। আমরা যে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, তার মানে হলো—একটি স্বনির্ভর বাংলাদেশ।”
সভা শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন দ্রুত উদ্যোগ নিতে, যেন বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ভিসা-প্রক্রিয়ার জটিলতা দূর করা যায়।
তিনি বলেন, “কিছু দেশে আমাদের ভিসা প্রক্রিয়া অস্বাভাবিকভাবে জটিল। অনেক সময় বাংলাদেশিদের ওইসব দেশে ভিসা পেতে হয় ভারতের নয়াদিল্লিতে গিয়ে, যা অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। প্রধান উপদেষ্টা চান এই প্রক্রিয়াটি সহজ ও দ্রুত হোক, যেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা নতুন বাজারে প্রবেশ করতে পারে।”
প্রেস সচিব জানান, বর্তমানে পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে—বিশেষ করে কসোভো, আলবেনিয়া, সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রোতে—বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফরের সময় অধ্যাপক ইউনূস এসব দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসেন এবং তাঁরা বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেন।
কিন্তু বাংলাদেশ এসব দেশে দূতাবাস স্থাপন না করায় ভিসা প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়ছে। অধ্যাপক ইউনূস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এই বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে সমাধানের নির্দেশ দিয়েছেন।
সভায় দেশের প্রধান ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা শিল্প ও রপ্তানি খাতের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন—বিশেষত গ্যাস সরবরাহ, ব্যাংক ঋণের সংকট, এবং এলসি খোলার জটিলতা। ব্যবসায়ীরা বলেন, ম্যানমেড ফাইবার ও রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। তাঁরা আরও প্রস্তাব দেন, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য নতুন রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট এবং ল্যান্ড-বেইস টার্মিনাল স্থাপন করা হোক, যা শিল্পোৎপাদন ধারাবাহিক রাখতে সহায়ক হবে।
এছাড়া ফার্মাসিউটিক্যালস, তৈরি পোশাক, তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃষি খাতের প্রতিনিধিরাও সভায় অংশ নিয়ে নিজেদের প্রস্তাব দেন। তাঁরা জানান, সরকার যদি ব্যাংকিং খাতের সুদের হার ও ঋণ সংকট নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে, তাহলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে।
প্রেস সচিব জানান, “মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়ে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চলছে। দর-কষাকষির সক্ষমতা বাড়াতে সরকার ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির সহায়তা নিচ্ছে।”
সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে মুদ্রাস্ফীতি ১২.৫ শতাংশ থেকে কমে ৮.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান। তিনি বলেন, সরকার নিয়ন্ত্রিত আমদানি, প্রবাসী আয় বৃদ্ধির প্রবণতা, এবং রপ্তানি আয় বাড়ার ফলে রিজার্ভ পরিস্থিতি স্থিতিশীল হচ্ছে।
গভর্নর আরও জানান, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম ও খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর অবস্থানে আছে। তিনি বলেন, “অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে হলে আর্থিক শৃঙ্খলা ও সুশাসন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।”
সভা শেষে প্রেস সচিব জানান, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ১২ অক্টোবর ইতালির রোমে যাবেন। তিনি সেখানে ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরাম-এর ফ্ল্যাগশিপ ইভেন্টে যোগ দেবেন। এই ফোরামটি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO)-এর উদ্যোগে আয়োজিত হয়, যেখানে বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র্য হ্রাস, ও টেকসই কৃষি উন্নয়ন নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
অধ্যাপক ইউনূস এই সফরে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেবেন, যেখানে বাংলাদেশের খাদ্য প্রযুক্তি, কৃষি উদ্ভাবন এবং প্রবাসী শ্রমবাজার সম্প্রসারণের বিষয়গুলোও আলোচিত হবে বলে জানা গেছে।
বৈঠকের শেষ অংশে প্রধান উপদেষ্টা পুনরায় সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেন, “নতুন বাংলাদেশ মানেই হবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ—যেখানে দেশের প্রতিটি মানুষ নিজের সক্ষমতা দিয়ে এগিয়ে যাবে, সরকারি সহায়তার ওপর নয়, বরং নিজস্ব উদ্যোগ ও উদ্ভাবন শক্তির ওপর নির্ভর করবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা যদি বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে পারি, তবে দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে সেই শ্রমিকদের আয় দ্বিগুণ করা সম্ভব। এজন্য সরকার কাজ করছে, যাতে প্রশিক্ষণ, ভাষা শিক্ষা ও প্রযুক্তি জ্ঞান বাড়ানো যায়।”
বৈঠকের সার্বিক বার্তা ছিল স্পষ্ট—ভিসা জটিলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবন্ধকতা দূর করে বাংলাদেশ নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে, একই সঙ্গে দেশীয় শিল্পে উৎপাদন বৃদ্ধি ও আত্মনির্ভরতার মাধ্যমে নতুন অর্থনৈতিক দিগন্ত উন্মোচন করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



