ছবি: সংগৃহীত
অবৈধভাবে কালো টাকা সাদা করার ঘটনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তিন কর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নেওয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় একজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, বাকি দুজনের বিরুদ্ধেও তদন্ত প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এ ঘটনা জড়িয়ে আছে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের দুই উত্তরসূরি—আশরাফুল আলম ও আসাদুল আলম মাহির—এর ৫০০ কোটি টাকার কালোটাকা সাদা করার অনিয়মের সঙ্গে।
বুধবার (৮ অক্টোবর ২০২৫) অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. আবদুর রহমান খানের স্বাক্ষরে জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনে এনবিআরের সহকারী কর কমিশনার মো. আমিনুল ইসলামকে সরকারি চাকরি থেকে অবসর দেওয়া হয়েছে। সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮–এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাঁকে জনস্বার্থে অবসর দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। যদিও প্রজ্ঞাপনে ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি, অভ্যন্তরীণ সূত্র নিশ্চিত করেছে যে এটি আসলে শাস্তিমূলক অবসর হিসেবেই কার্যকর করা হয়েছে।
এর ঠিক আগের দিন, মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর), মো. আমিনুল ইসলামের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। কিন্তু পরদিনই তাঁকে হঠাৎ অবসরে পাঠানো হয়, যা প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের কাছে একটি ‘দ্রুত ও কৌশলগত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই ঘটনার সূত্রপাত ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর, যখন অভিযোগ ওঠে যে তিন কর কর্মকর্তা—অতিরিক্ত কর কমিশনার সাইফুল আলম, যুগ্ম কর কমিশনার এ কে এম শামসুজ্জামান এবং সহকারী কর কমিশনার মো. আমিনুল ইসলাম—অবৈধভাবে এস আলম গ্রুপের দুই উত্তরাধিকারীর কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করেছেন। অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাঁদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ১০ শতাংশ কর প্রদান করে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দিয়েছিল। এই সুযোগ গ্রহণ করে এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের দুই পুত্র—আশরাফুল আলম ও আসাদুল আলম মাহির—৫০০ কোটি টাকার অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করেন। কিন্তু এই বৈধকরণ প্রক্রিয়ায় কর ফাঁকি ও জাল লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ৭৫ কোটি টাকা কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।
সূত্র জানায়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৈধকরণের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ করহার প্রযোজ্য হলেও তাঁরা দিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ—অর্থাৎ ৫০ কোটি টাকা, যেখানে প্রকৃতপক্ষে তাঁদের দিতে হতো ১২৫ কোটি টাকা। কর ফাঁকির এই পার্থক্যই পুরো অনিয়মের কেন্দ্রবিন্দু।
অভিযোগ অনুযায়ী, দুই ভাই ব্যাংকের দুটি জাল পে-অর্ডার ব্যবহার করে কর পরিশোধের দেখানো নথি জমা দেন। এনবিআরের সংশ্লিষ্ট তিন কর্মকর্তা এই জাল নথি যাচাই না করেই অনুমোদন প্রদান করেন। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয় প্রায় ৭৫ কোটি টাকা।
ঘটনার প্রায় এক বছর পর, ২০২৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই ঘটনায় ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে এস আলম গ্রুপের দুই পুত্র আশরাফুল আলম ও আসাদুল আলম মাহিরের পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের সাত কর্মকর্তা ও এনবিআর কর্মকর্তা মো. আমিনুল ইসলামের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় দুটি জাল পে-অর্ডার তৈরি করা হয়, যা বৈধ বলে দেখিয়ে এনবিআর কর্মকর্তাদের মাধ্যমে অনুমোদন নেওয়া হয়। এতে কর প্রদানের ভুয়া তথ্য সিস্টেমে রেকর্ড হয় এবং বৈধকরণের প্রমাণপত্র জারি করা হয়।
দুদক সূত্রের ভাষায়, “আমিনুল ইসলাম ছিলেন এই পুরো প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যক্তি। তিনি কর যাচাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন এবং তাঁর অনুমোদন ছাড়া ফাইল অগ্রসর হওয়ার কথা নয়।”
সাময়িক বরখাস্তের সময় অতিরিক্ত কর কমিশনার সাইফুল আলম চট্টগ্রাম কর আপিল অঞ্চলে দায়িত্বে ছিলেন। তিনি এর আগে কর অঞ্চল-১, চট্টগ্রামে যুগ্ম কর কমিশনার ছিলেন।
যুগ্ম কর কমিশনার এ কে এম শামসুজ্জামান তখন কর অঞ্চল-১৪, ঢাকা অফিসে কর্মরত ছিলেন। এর আগে তিনিও কর অঞ্চল-১, চট্টগ্রামে ছিলেন।
সহকারী কর কমিশনার মো. আমিনুল ইসলাম কর্মরত ছিলেন কর অঞ্চল-২, চট্টগ্রামে; এর আগে তিনি কর অঞ্চল-১ এর অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার (ইএসিটি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
তদন্ত সংক্রান্ত নথি বলছে, এই তিন কর্মকর্তার মধ্যে সমন্বয় ছিল এবং তাঁরা নিয়ম ভঙ্গ করে অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজ করে দিয়েছিলেন। প্রশাসনিক সূত্র মনে করছে, তাঁরা হয়তো “উর্ধ্বতন চাপ” বা “অর্থনৈতিক প্রলোভন”—উভয়েরই শিকার হয়েছেন।
সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ৪৫ ধারা অনুযায়ী, সরকার জনস্বার্থে কোনো কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অবসর দিতে পারে যদি তাঁর চাকরিকাল ২৫ বছর অতিক্রম করে। তবে সাধারণত এই ধারায় অবসর দেওয়া হয় ‘বাধ্যতামূলক অবসর’ হিসেবে, যা একটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মো. আমিনুল ইসলাম ২৫ বছর চাকরি পূর্ণ করেছেন এবং তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের প্রমাণ পাওয়ায় এই ধারা প্রয়োগ করা হয়েছে। তিনি অবসরকালীন ভাতা ও পেনশন সুবিধা পাবেন, তবে ভবিষ্যতে কোনো সরকারি নিয়োগ বা পুনর্বহালের সুযোগ পাবেন না।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এই ঘটনাকে একটি ‘নির্দেশনামূলক দৃষ্টান্ত’ হিসেবে দেখছে। এনবিআরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া হয়েছে—যে কর্মকর্তাই প্রভাবশালী করদাতা বা ব্যবসায়ীকে অবৈধ সুবিধা দেবেন, তাঁকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
তিনি আরও বলেন, “এটি শুধু একটি ব্যক্তি-নির্ভর শাস্তি নয়, বরং সমগ্র কর প্রশাসন ব্যবস্থাকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রশাসনিক বার্তা।”
এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্রের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁরা সাড়া দেননি।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘটনা কর প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। একই সঙ্গে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারি সংস্থাগুলোর ‘বিশেষ সুবিধা’ সংস্কৃতি যে এখনও বিদ্যমান, তাও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
সারসংক্ষেপে, ৫০০ কোটি টাকার কালোটাকা সাদা করার প্রক্রিয়ায় ৭৫ কোটি টাকার কর ফাঁকি ও জাল পে-অর্ডারের মাধ্যমে এনবিআরের কর্মকর্তাদের অবৈধ সহযোগিতা—এই কেলেঙ্কারি শুধু ব্যক্তিগত দুর্নীতি নয়, বরং রাষ্ট্রীয় রাজস্ব ব্যবস্থার আস্থার সংকটের প্রতিচ্ছবি। এক বছরের মধ্যে সাময়িক বরখাস্ত থেকে বাধ্যতামূলক অবসর—এই ঘটনাপ্রবাহ সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে শুদ্ধি অভিযান জোরদারের ইঙ্গিত বহন করছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



