ছবি: সংগৃহীত
দেশের অর্থনীতি বর্তমানে গভীর মন্দার ছায়ায় ঢেকে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যিক পরিবেশে আস্থাহীনতা, উচ্চ সুদের হার, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। একদিকে শিল্প খাতের উৎপাদন ও আমদানি কার্যক্রম কমছে, অন্যদিকে রপ্তানি হ্রাস ও অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা কমে যাওয়ায় দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি মারাত্মক চাপে পড়েছে। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বলছেন—বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন “রোগীর আইসিইউ” অবস্থায়, টিকে আছে কেবল প্রাণবায়ুর ওপর।
দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ চরমে উঠেছে। রাজধানীসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে চুরি, ছিনতাই, দখলবাজি, এমনকি ব্যবসায়ীদের ওপর হয়রানির অভিযোগ বেড়ে গেছে। অনেক শিল্পোদ্যোক্তা জানান, তাঁদের কারখানাগুলো হঠাৎ করেই প্রশাসনিক অভিযানে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে—ফলে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছেন না, উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন শিল্পমালিকের মতে, এই পরিস্থিতিতে নতুন কোনো ব্যবসা বা প্রকল্পে বিনিয়োগের চিন্তাও করা যাচ্ছে না। বরং অনেকেই চলমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন। শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বড় অংশই এখন অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন ৫০ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।
বর্তমানে দেশের শিল্প খাত তিনটি বড় চাপে রয়েছে—ডলারের ঘাটতি, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ, এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস।
ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে খরচ বেড়ে গেছে ২৫-৩০ শতাংশ। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু পণ্যের দাম বাড়ালে বাজারে বিক্রি কমে যাচ্ছে।
এদিকে ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ শতাংশে। এতে ব্যবসায়ীরা কার্যত নতুন কোনো ঋণ নিতে আগ্রহী নন। উৎপাদনশীল খাতগুলোতে তীব্র তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে, বেকার হচ্ছে লাখো শ্রমিক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে গেছে। কর-জিডিপি অনুপাত কমে ৬.৮ শতাংশে ঠেকেছে—যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম নিম্ন হার।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে “মন্দার ছায়ায়” আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি জানায়, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ গত ২২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে এসেছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে, ব্যাংক খাতে অনিয়ম বেড়েছে, এবং ঋণখেলাপির হার বেড়ে ২৪.১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে—যা রেকর্ড।
সংস্থাটি আরও বলেছে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ব্যাংক খাতের দুর্বলতা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রপ্তানি খাতেও পতন ধরা পড়েছে। আগস্টে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমেছে ৩ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে আরও নেমেছে ৪.৬১ শতাংশ। বিশেষ করে প্রস্তুত পোশাক খাত, যা দেশের মোট রপ্তানির ৮৫ শতাংশের বেশি, সেখানেও ক্রয়াদেশ হ্রাসের প্রভাব স্পষ্ট।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল হাই সরকার বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই এখন নিচের দিকে। নীতিনির্ধারকরা ব্যবসায়ীদের সমস্যার কথা বোঝেন না। তাঁরা কেবল তত্ত্ব জানেন, বাস্তবতার সঙ্গে তাঁদের কোনো সংযোগ নেই। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ছাড়া কোনো শিল্প টিকে থাকতে পারে না, অথচ এই দুই খাতেই অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।”
তিনি আরও বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশীয়দের অবস্থাই আগে দেখেন। তাঁরা যখন দেখছেন আমরা নিজেরাই টিকতে পারছি না, তখন কেউই বিনিয়োগে আসতে চায় না।”
প্রস্তুত পোশাক খাতের উদ্যোক্তা ও বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, “বর্তমান অবস্থা হলো—রোগী এখনও বেঁচে আছে বলেই সবাই খুশি। কিন্তু বাস্তবে অর্থনীতি শ্বাসরুদ্ধ। সরকার বলছে অর্থনীতি চলছে, কিন্তু সেটা কেবল টিকে থাকার পর্যায়ে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছি—ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিয়ে পরিকল্পনা করা দরকার। কিন্তু সরকার মনে করে না, বসে কথা বলার প্রয়োজন আছে। এখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় সবাই অপেক্ষা করছে নতুন সরকারের জন্য। তার আগে কোনো পরিবর্তন হবে না।”
ঢাকা চেম্বারের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসেন খালেদ বলেন, “অর্থনীতিতে মন্দার ছায়া গভীর হচ্ছে কারণ সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পগুলো কার্যত স্থবির। জিডিপির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আসে সরকারি প্রকল্প থেকে। এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বেসরকারি খাতও জড়িত থাকে। যখন প্রকল্প বন্ধ বা ধীরগতির হয়, তখন গোটা সাপ্লাই চেইন থেমে যায়।”
তিনি বলেন, “এক বছর ধরে সরকারিভাবে নতুন কোনো বড় ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট হয়নি। বেসরকারি খাতও আস্থা হারিয়েছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এখন প্রায় সবাই অর্ধেক সক্ষমতায় চলছে। হয়তো নতুন সরকার আসার ছয় মাস পর কিছুটা পরিবর্তন আসবে, কিন্তু তার আগে কোনো আশার আলো নেই।”
উইমেন এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডব্লিউইএবি) প্রেসিডেন্ট নাসরিন আউয়াল মিন্টু বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনে দেশে এখন দায়বদ্ধতা নেই। যার যা ইচ্ছা তাই করছে। আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। নারী উদ্যোক্তারা লুটপাট, হয়রানি ও ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “ভল্ট ভেঙে জুয়েলারির দোকান লুট হচ্ছে, কেউ নিরাপদ নন। বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষা করছেন স্থিতিশীল রাজনৈতিক সরকারের জন্য। সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া এই অরাজকতা যাবে না। এখন সবাই টিকে থাকার লড়াই করছে, নারীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।”
অ্যাকসেসরিজ ও প্যাকেজিং খাতের সংগঠন বিজিএপিএমইএ’র প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ শাহরিয়ার জানান, “আমাদের সেক্টরের ৪৩ শতাংশ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। উচ্চ সুদের হার, জ্বালানির ঘাটতি এবং ক্রয়াদেশ কমে যাওয়াই এর মূল কারণ।”
তিনি বলেন, “আগে ঋণের সুদ ছিল ৯ শতাংশ, এখন ১৬ শতাংশ। বিদ্যুৎ পেলেও দাম বেশি, ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। বিদেশি ক্রেতারা দাম কমিয়ে দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে সবাই টিকে থাকার লড়াই করছে। সাড়ে আট হাজার শ্রমিক ইতোমধ্যেই চাকরি হারিয়েছেন।”
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন মূলত আস্থার সংকটে ভুগছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নীতির অস্থিরতা মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে পারছেন না।
একজন অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেন, “অর্থনীতি চালু আছে, কিন্তু গতিময় নয়। বিনিয়োগ ছাড়া প্রবৃদ্ধি টেকসই হয় না। এখন দেশের অর্থনীতি চলমান প্রকল্পের উপর নির্ভর করছে, কিন্তু নতুন প্রবৃদ্ধির উৎস তৈরি হচ্ছে না।”
বাংলাদেশের ব্যবসায়িক খাত এখন এক গভীর অচলাবস্থার মুখে দাঁড়িয়ে। শিল্প-উৎপাদন, রপ্তানি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান—সব সূচকেই পতনের ধারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁরা এখন টিকে থাকার চেষ্টায় ব্যস্ত, লাভের কথা ভুলে গেছেন অনেক আগেই। সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর নীতিগত উদ্যোগ ও আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া না হলে, আগামী বছরগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দা আরও গভীর হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



