ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক সমঝোতার পথ খোঁজার লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গণভোটের সময় ও প্রক্রিয়া নির্ধারণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দায়িত্ব নিজ হাতে রেখেছে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে অনুষ্ঠিত এ সংলাপ প্রক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্নমত ও সমর্থন উভয়কেই গুরুত্ব দিয়েই শেষ হয়েছে। এখন কমিশন রাজনৈতিক দলের মতামত, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ এবং জনমতের ভারসাম্য বিবেচনায় নিয়ে সরকারকে চূড়ান্ত সুপারিশ করবে বলে জানিয়েছে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
বুধবার (৮ অক্টোবর) রাতে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত কমিশনের সমাপনী বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে এসে অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, “আজকের আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংলাপের আনুষ্ঠানিক পর্ব শেষ হলো। তবে কমিশনের কাজ এখানেই শেষ নয়। এখন মূল দায়িত্ব হবে সংলাপে পাওয়া মতামত ও প্রস্তাবনাগুলো বিশ্লেষণ করে গণভোটের কাঠামো তৈরি করা এবং সেই অনুযায়ী সরকারের কাছে পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাবনা পেশ করা।”
তিনি বলেন, “আগামী সংসদ তার নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যেই জুলাই সনদের সংশোধনসমূহ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করবে—এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতিগত ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। তবে গণভোট কবে এবং কীভাবে হবে, এ বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, গণভোট দ্রুত হওয়া উচিত, আবার কেউ বলেন, প্রথমে প্রয়োজন সংশোধনগুলোর বিষয়ে জাতীয় আলোচনার একটি পর্যায়। এই মতপার্থক্যগুলো আমরা নথিভুক্ত করেছি।”
অধ্যাপক আলী রীয়াজ আরও জানান, কমিশন আগামী দু’এক দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামত সমন্বয় করে সরকারকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেবে। তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো এমন একটি রূপরেখা তৈরি করা যাতে গণভোটের সময়সীমা ও প্রক্রিয়া নিয়ে আর কোনো অনিশ্চয়তা না থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক মূল্যবান মত এসেছে, অনেক বাস্তবসম্মত প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। এখন সেগুলো একত্র করে আমরা সরকারের কাছে একটি বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ পাঠাব।”
তিনি জানান, “আগামী ১৫ বা ১৭ অক্টোবরের মধ্যে ঐতিহাসিক দলিল স্বাক্ষরের অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। এর আগে কমিশন জুলাই সনদের খসড়া ও গণভোট সংক্রান্ত প্রস্তাব সরকারের হাতে তুলে দেবে।” এছাড়া ১৮-১৯ অক্টোবরের মধ্যে কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশের কথাও জানিয়েছেন তিনি।
আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ প্রায় সব বড় রাজনৈতিক দলই আলোচনায় অংশ নিয়েছে। অধিকাংশ বিষয়ে তারা একমত হলেও কিছু ইস্যুতে ভিন্নমত থেকে গেছে, বিশেষ করে গণভোটের সময় ও প্রক্রিয়া নিয়ে। কারও মতে, জনগণের সরাসরি মতামত নেওয়া এখনই প্রয়োজন, আবার কেউ কেউ মনে করেন, সংবিধান সংশোধনের কিছু ধাপ আগে সম্পন্ন হওয়া দরকার।”
তিনি আরও বলেন, “এখানে দুটি প্রশ্ন থাকবে—একটি হলো যে বিষয়গুলোতে পূর্ণ ঐকমত্য হয়েছে, আরেকটি হলো যেখানে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। জনগণ সেই দুটি প্রশ্নের ওপর ভোট দেবেন। অর্থাৎ গণভোটে জনগণ শুধু সমর্থন বা বিরোধিতা নয়, বরং পার্থক্যপূর্ণ মতামতের ক্ষেত্রেও নিজেদের অবস্থান জানানোর সুযোগ পাবেন।”
কমিশনের সহসভাপতি বলেন, “জুলাই সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট বা ভিন্নমতের বিষয়গুলোও আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। এটি কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের প্রতিফলন নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার একটি সুযোগ।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “এখন কমিশনের সামনে প্রধান কাজ হলো রাজনৈতিক মতামতগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করা এবং বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে একটি কার্যকর বাস্তবায়ন রূপরেখা তৈরি করা। আমরা আশা করছি, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই এ বিষয়ে কমিশনের অভ্যন্তরীণ বৈঠক সম্পন্ন হবে এবং চূড়ান্ত প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানো হবে।”
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, “গণভোটের তারিখ, প্রশ্ন নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, প্রচার নির্দেশিকা ও ফলাফল প্রকাশের কাঠামো—সবকিছুই কমিশনের আলোচনার অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এটি শুধু একটি ভোট নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি মাইলফলক হতে যাচ্ছে।”
তিনি শেষে বলেন, “আমরা চাই এই প্রক্রিয়া যেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন আস্থা তৈরি করে। গণভোটের মাধ্যমে জনগণ সরাসরি বলতে পারবে তারা জুলাই সনদের প্রস্তাবিত রূপটি চায় কি না। সরকার, কমিশন ও রাজনৈতিক দল—সব পক্ষের সমন্বিত উদ্যোগেই এই ঐতিহাসিক কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা জানিয়েছেন, সরকার চাইলে গণভোটের আয়োজন চলতি বছরের মধ্যেই শুরু করা সম্ভব, তবে সবকিছু নির্ভর করবে কমিশনের প্রস্তাবনা অনুমোদনের ওপর। আগামী সপ্তাহে কমিশনের চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত হবে এবং এর পরপরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সারসংক্ষেপে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার ফলাফল এখন সরকারের হাতে থাকা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া মতামত ও ভিন্নমতের আলোকে নির্ধারিত হবে গণভোটের সময়, প্রশ্ন এবং প্রক্রিয়া—যা হতে পারে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



