ছবি: সংগৃহীত
দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের প্রবাহ চলতি অক্টোবর মাসের শুরু থেকেই শক্তিশালী গতিতে এগোচ্ছে। মাত্র সাতদিনেই ব্যাংকিং চ্যানেলে এসেছে প্রায় ৬৯ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসেবে) প্রায় ৮ হাজার ৪৪২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। প্রতিদিন গড়ে দেশে এসেছে প্রায় ১০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স, যা বছরের এই সময়ের জন্য এক রকম ইতিবাচক রেকর্ড বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছর ২০২৫-২৬ এর অক্টোবরের প্রথম সাতদিনে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি। গত বছরের একই সময়ে যেখানে রেমিট্যান্স এসেছিল ৬৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ কোটি ২০ লাখ ডলারে। অর্থাৎ বছরে বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১.৩২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এক বিবৃতিতে জানান, “অক্টোবরের শুরুটা বেশ ইতিবাচক। হুন্ডি বা অবৈধ চ্যানেলের পরিবর্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবণতা বেড়েছে। ফলে রেমিট্যান্সের গতি টেকসইভাবে বাড়ছে।”
তিনি আরও জানান, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে (জুলাই–৭ অক্টোবর পর্যন্ত) মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৮২৭ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ফলে এই তিন মাসের কিছু বেশি সময়ে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে রেমিট্যান্স খাত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার (২৬৮ কোটি ৫৮ লাখ ডলার)। এর আগে আগস্টে এসেছিল ২৪২ কোটি ১৯ লাখ ডলার, আর জুলাইয়ে আসে ২৪৭ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। অর্থাৎ তিন মাস ধরেই রেমিট্যান্স প্রবাহ রয়েছে তুলনামূলক ভালো অবস্থায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, সেপ্টেম্বরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিশেষ করে সৌদি আরব, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারে প্রবাসী শ্রমিকদের বেতন বিতরণের সময় পড়েছিল। ফলে মাসের শেষ সপ্তাহে রেমিট্যান্সের প্রবাহ ছিল উল্লেখযোগ্য।
বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বিস্তৃত হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও ইউরোপ, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মতো দেশে। নতুন নতুন দেশে জনশক্তি রপ্তানির সুযোগ তৈরি হওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহে বৈচিত্র্য এসেছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের শেষভাগ থেকে ইতালি, রোমানিয়া, পোল্যান্ড ও ক্রোয়েশিয়ার মতো দেশে শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় নতুন উৎস থেকে আয় বাড়ছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, "এখন রেমিট্যান্সের বড় অংশই আসছে ব্যাংকিং চ্যানেলে। সরকারি হুন্ডিবিরোধী অভিযান, প্রণোদনা নীতিমালা, এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশ থেকে অর্থ পাঠানোর সহজ ব্যবস্থা রেমিট্যান্স বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।"
বর্তমানে সরকার রেমিট্যান্স পাঠানো প্রবাসীদের জন্য ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা প্রদান করে থাকে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দ্রুত টাকা উত্তোলন ও অনলাইন ট্রান্সফারের সুবিধা দিয়েছে। ফলে অনেক প্রবাসীই এখন হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন।
বেসরকারি খাতের ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে, ডিজিটাল ব্যাংকিং ও অ্যাপভিত্তিক অর্থ প্রেরণ ব্যবস্থা এখন রেমিট্যান্সের গতি অনেক বাড়িয়েছে। যেমন, বীক্যাশ, নগদ, রকেট ও উপায়-এর মতো সেবার মাধ্যমে এখন অনেক প্রবাসী পরিবার সরাসরি মোবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা পাচ্ছে। এতে সময় বাঁচছে, খরচ কমছে, এবং স্বচ্ছতাও বাড়ছে।
গত অর্থবছরে (২০২৪–২৫) মোট রেমিট্যান্স এসেছে ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের (২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন) তুলনায় ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ টানা দ্বিতীয় বছর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেরেছে এই খাত।
গত অর্থবছরে রেমিট্যান্সের মাসভিত্তিক চিত্র অনুযায়ী মার্চ ছিল সবচেয়ে উজ্জ্বল মাস, যখন প্রবাসীরা পাঠান ৩২৯ কোটি ডলার, যা পুরো অর্থবছরের সর্বোচ্চ। এছাড়া মে মাসে আসে ২৯৭ কোটি ডলার, আর জুনে ২৮২ কোটি ডলার, যা বছরের শেষভাগে শক্তিশালী রেমিট্যান্স প্রবাহ নির্দেশ করে।
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখতে হলে প্রবাসী শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়ানো এবং নতুন শ্রমবাজারে দ্রুত প্রবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। এখনো বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে বাংলাদেশি শ্রমিক পাঠাতে নানা প্রশাসনিক জটিলতা রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, “রেমিট্যান্স বাড়ছে—এটা খুবই ভালো খবর। কিন্তু একইসঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে যেন এই প্রবৃদ্ধি সাময়িক না হয়। দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখতে হলে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার আরও আধুনিকীকরণ জরুরি।”
সবমিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, রেমিট্যান্স এখনো বাংলাদেশের অর্থনীতির এক প্রধান স্তম্ভ হিসেবে কাজ করছে। রপ্তানি আয় ও বৈদেশিক ঋণচাপের মাঝেও এই প্রবাহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল রাখছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভ আছে প্রায় ৪৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার একটি বড় অংশই রেমিট্যান্স থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা।
অর্থনীতিবিদদের মতে, যদি এই প্রবৃদ্ধি ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ বাংলাদেশ রেমিট্যান্সে নতুন রেকর্ড গড়তে পারে—যার পরিমাণ ৩২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
অক্টোবরের প্রথম সাতদিনের রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রমাণ করেছে, বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের অবদান এখনো দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, ডলারের বাজারে অস্থিরতা কিংবা আমদানি ব্যয়—সবকিছুর মাঝেও প্রবাসী আয়ের এই ধারাবাহিকতা অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সমন্বিত উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে, এই খাত আগামী বছরেও নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলেই আশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



