
ছবি: সংগৃহীত
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসজুড়ে দেশের বিভিন্ন সড়কপথে ভয়াবহভাবে বেড়েছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার সংখ্যা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, শুধুমাত্র এপ্রিল মাসেই দেশের সড়কপথে ৫৬৭টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৮৩ জন মানুষ। আহত হয়েছেন অন্তত ১ হাজার ২০২ জন। একই সঙ্গে রেল ও নৌপথেও প্রাণহানির ঘটনাও অব্যাহত ছিল। সব মিলিয়ে সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ৬১০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬২৮ জন এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ২০৭ জন।
মঙ্গলবার (৬ মে) যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশের জাতীয়, আঞ্চলিক ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত দুর্ঘটনার সংবাদ বিশ্লেষণ ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এই রিপোর্ট তৈরি করেছে সমিতির দুর্ঘটনা মনিটরিং সেল।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, শুধু সড়কপথেই যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে তা নয়, বরং নৌপথেও এপ্রিল মাসে ৮টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১০ জন এবং নিখোঁজ হয়েছেন ১ জন। অন্যদিকে রেলপথেও দুর্ঘটনার প্রবণতা উদ্বেগজনক। ৩৫টি রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৩৫ জন এবং আহত হয়েছেন ৫ জন।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীরা। এ মাসে ২১৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২২৯ জন এবং আহত হয়েছেন ২২৪ জন। এককভাবে এই সংখ্যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৭.৯১ শতাংশ, মোট নিহতের ৩৯.২৭ শতাংশ এবং মোট আহতের ১৮.৬৪ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, সড়কে চলাচলকারী মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।
ভৌগোলিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যানে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এপ্রিল মাসে এ বিভাগে ১৩৮টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৩৬ জন এবং আহত হয়েছেন ৩৭৭ জন। অন্যদিকে সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে সিলেট বিভাগে, যেখানে ২৮টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩১ জন এবং আহত হয়েছেন ৫১ জন।
দুর্ঘটনার ধরন ও কারণ বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, এপ্রিল মাসে সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ৫০.৯৭ শতাংশ ঘটেছে গাড়ি চাপায়। মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে ২৩.৮০ শতাংশ দুর্ঘটনায়, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮.৫১ শতাংশ ক্ষেত্রে। এছাড়াও ৫.৯৯ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে নানা বিবিধ কারণে, আর চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে ০.৩৫ শতাংশ এবং ট্রেন ও যানবাহনের সংঘর্ষে ০.৩৫ শতাংশ দুর্ঘটনা হয়েছে।
সড়ক ব্যবস্থার ধরণভেদে বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাতীয় মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি ৩১.৭৪ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে, আঞ্চলিক মহাসড়কে ২৯.১০ শতাংশ এবং ফিডার রোডে ৩৩.৬৮ শতাংশ দুর্ঘটনা হয়েছে। মহানগরভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে ৪.০৫ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম মহানগরীতে ১.০৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেখানে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার হার ০.৩৫ শতাংশ।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এসব ভয়াবহ দুর্ঘটনার পেছনে মূলত বেপরোয়া গাড়ি চালনা, ট্রাফিক আইন না মানা, যত্রতত্র ফুটপাত দখল, রাস্তায় চলাচলের অনুপযোগী যানবাহনের ব্যবহার এবং পর্যাপ্ত সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কাজ করছে। বিশেষ করে মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাক, বাস এবং দ্রুতগামী যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীন গতিই প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনায় দেশের মানবসম্পদের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৮ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে অনেক তরুণ, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, ছাত্র ও শ্রমজীবী মানুষের মৃত্যুতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
তাই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে শুধু আইন করে নয়, বাস্তবায়ন, যানবাহনের মান নিয়ন্ত্রণ, চালকদের প্রশিক্ষণ এবং সুশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করাও এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সড়কে প্রতিদিন বেড়ে চলা প্রাণহানির এ চিত্র কেবল সংখ্যা নয়, এটি প্রতিটি পরিবারের বেদনার গল্প, যেটি এখনই রোধ করা জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ