
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গুমসংক্রান্ত ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ মামলায় একযোগে ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি—এমন ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রায় নজিরবিহীন। বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে ১৫ জন বর্তমান কর্মরত কর্মকর্তা হওয়ায় বিষয়টি শুধু সেনা সদর নয়, পুরো দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
সেনাবাহিনীর অবস্থান: ‘ন্যায়ের পক্ষে, ইনসাফে কোনো আপস নয়’
গত শনিবার সেনা সদর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আদালতের আদেশ পাওয়ার পরই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা দেখিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনী কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ১৬ কর্মকর্তাকে স্বেচ্ছায় হেফাজতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। তাঁদের মধ্যে ১৫ জন ইতিমধ্যে সেনা হেফাজতে এসেছেন, একজনকে অনুপস্থিত ঘোষণার প্রক্রিয়া চলছে।
সেনাপ্রধানের বক্তব্য উদ্ধৃত করে সেনা সদর জানায়, “আমরা সব সময় ন্যায়ের পক্ষে। ইনসাফের সঙ্গে কোনো আপস নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল।”
তবে একই সঙ্গে সেনা সদর স্বীকার করে, হঠাৎ এ ধরনের ঘটনা সেনা সদস্যদের মনোবলে সাময়িক প্রভাব ফেলেছে। সেনাবাহিনী মনে করে, বিচারের প্রক্রিয়া যেভাবে গণমাধ্যমে উপস্থাপিত হচ্ছে, তা অনেক সময় একটি প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বিচারপূর্ব পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ
বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই ‘দোষী সাব্যস্ত’ করে ফেলার প্রবণতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা। তাঁদের মতে, আইনের শাসন মানে হলো—বিচার না হওয়া পর্যন্ত কেউ অপরাধী নন। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর উপস্থাপন এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করছে, যেখানে অভিযুক্তরা আগে থেকেই সমাজে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাচ্ছেন।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাহেদুর রহমান বলেন, “যে কেউ অপরাধ করলে অবশ্যই তার বিচার হবে, কিন্তু আমরা যেন পুরো প্রতিষ্ঠানকে অভিযুক্ত না করি। সেনাবাহিনী দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কয়েকজন সদস্যের জন্য পুরো বাহিনীর ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হলে সেটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও মনোবলের জন্য ক্ষতিকর।”
তিনি আরও বলেন, “আমি ৩৪ বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করেছি। বাহিনী কখনো কাউকে অপরাধ শেখায় না। কেউ যদি লোভ, রাজনৈতিক চাপ বা অন্য কোনো কারণে অপরাধে লিপ্ত হয়, তার দায় একান্তই ব্যক্তির। প্রতিষ্ঠান নয়।”
সেনা সদর ব্রিফিং: আইনগত বাস্তবতা তুলে ধরলেন কর্মকর্তারা
সেনা সদর ব্রিফিংয়ে অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মো. হাকিমুজ্জামান বলেন, “আইসিটি আইনে বলা আছে, অভিযোগপত্রে নাম থাকলেই চাকরি চলে যাবে। কিন্তু চার্জশিট মানেই দোষী সাব্যস্ত হওয়া নয়। অভিযুক্তদের আপিল করার অধিকার আছে। আপিল শেষে যদি সাজা বহাল থাকে, তখনই তাঁকে দোষী বলা যাবে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “কেউ যদি বিচারাধীন অবস্থায় সামাজিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন, এমনকি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন বা মৃত্যুবরণ করেন—এই মানবিক দিকগুলোও বিবেচনায় রাখা উচিত।”
আইনের সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উম্মে ওয়ারা তাঁর সাম্প্রতিক এক নিবন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন, আইসিটি আইনে চার্জশিট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাকরিচ্যুতির বিধান বিচার পূর্বেই এক ধরনের শাস্তি হিসেবে কাজ করছে কি না।
অন্যদিকে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, “সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনের বৈধতা নিয়ে অন্য কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। তবে বাস্তবে এ আইনের কিছু ধারা বিচারবহির্ভূত শাস্তির ঝুঁকি তৈরি করছে।”
তিনি আরও ব্যাখ্যা দেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের আন্তর্জাতিক আইনের ধারা অনুসরণ করেই এই আইন তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের এখানে সেটিকে সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রয়োগ করা হচ্ছে, যেখানে চার্জশিটই প্রায় দোষ স্বীকারের সমান হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
সামরিক না বেসামরিক আদালতে বিচার?
আরেক বিতর্কিত প্রশ্ন হলো—এই কর্মকর্তাদের বিচার সামরিক আদালতে হতে পারে কি না। এ বিষয়ে সাবেক জাজ অ্যাডভোকেট জেনারেল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ সাজ্জাদ সিদ্দিক বলেন, “সেনা আইনের ৫৭(২) ধারা অনুযায়ী গুমের সঙ্গে যেহেতু হত্যার অভিযোগও জড়িত, তাই এই অপরাধ সামরিক আদালতে বিচারযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে বেসামরিক আদালতই উপযুক্ত মঞ্চ।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া: বিএনপি ও জামায়াতের অবস্থান
বিএনপি বলেছে, গুম ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অবশ্যই হওয়া উচিত, তবে সেটি যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীর স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়,
“ন্যায়বিচার শুধু অতীতের শাস্তি নয়, ভবিষ্যতের সুরক্ষাও নিশ্চিত করে। কিন্তু কিছু ব্যক্তির অপরাধের দায় পুরো প্রতিষ্ঠান বা বাহিনীর ওপর চাপানো অনুচিত। অপরাধের দায় কেবল ব্যক্তির।”
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ফেসবুকে লেখেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতির গর্ব। তবে কিছু সদস্য যদি রাজনৈতিক প্ররোচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করে থাকেন, তাহলে তাঁদের বিচার হওয়া জরুরি। কিন্তু এর দায় পুরো বাহিনীর ওপর চাপানো যাবে না। সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে অভিযুক্তদের হেফাজতে নিয়ে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে, এটি প্রশংসনীয়।”
গণমাধ্যম ও জনমতের প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এক শ্রেণির মানুষ বলছেন, “এটাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সূচনা”, অন্যদিকে কেউ কেউ এটিকে “রাজনৈতিক প্রভাবিত পদক্ষেপ” হিসেবে দেখছেন।
বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সচেতন নাগরিকদের আশঙ্কা—যদি ট্রায়ালটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়, তাহলে এটি কেবল সেনাবাহিনী নয়, পুরো বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা নষ্ট করবে।
গুম-সংক্রান্ত মামলায় সেনা কর্মকর্তাদের বিচার নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই বিচারের মাধ্যমে সত্য উন্মোচিত হলে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ও মানবাধিকারের অবস্থান আরও দৃঢ় হবে। তবে আইনপ্রয়োগের নামে যদি কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনাবশ্যকভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়, তবে তা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও মনোবলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বিচার হোক, তবে যেন তা হয় প্রমাণ-নির্ভর, ন্যায়ের মানদণ্ডে স্বচ্ছ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত—এটাই এখন দেশের সচেতন নাগরিকদের প্রত্যাশা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ