
ছবি: সংগৃহীত
দুই প্রতিবেশী পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনার বিস্ফোরণ ঘটেছে। সীমান্ত সংঘাত ও পাল্টা হামলার প্রেক্ষাপটে ইসলামাবাদ দাবি করেছে, ভারতের ছোড়া মিসাইল হামলার জবাবে তারা পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফ বুধবার (৭ মে) যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই দাবি করেন। শুধু তাই নয়, তিনি আরও বলেন, কয়েকজন ভারতীয় সেনাকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করা হয়েছে।
খাজা আসিফের হুঁশিয়ারি ও আলোচনার প্রস্তাব
প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, পাকিস্তান যুদ্ধ চায় না, বরং আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের পথেই থাকতে চায়। তবে তিনি একই সঙ্গে সতর্ক করে বলেন, ভারত যদি আগ্রাসী মনোভাব পোষণ করে, তাহলে তার জবাবে পাকিস্তানও প্রতিরোধমূলক এবং পাল্টা হামলা চালাতে বাধ্য হবে।
তিনি বলেন, “যদি এসব শত্রুতাপূর্ণ কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়, আমরা অবশ্যই ভারতের সঙ্গে কথা বলব। আমরা চাই না এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হোক। কিন্তু ভারত থেকে যদি শত্রুতাপূর্ণ কিছু আসে, তাহলে আমাদের জবাব দিতে হবে।”
এই বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, একদিকে পাকিস্তান শান্তিপূর্ণ আলোচনা চাইলেও, অন্যদিকে তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও জবাবদিহিতার বার্তা দিতে চায়।
পাল্টা হামলায় ভারতীয় ব্রিগেড সদরদপ্তরে হামলার দাবি
সামরিক সূত্র ও রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম পিটিভির খবরে উঠে এসেছে আরও বিস্ফোরক দাবি। বলা হচ্ছে, পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্রিগেড সদরদপ্তর লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে এবং সেটি আংশিকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে।
বিশেষ করে ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখা (লাইন অব কন্ট্রোল) বরাবর দুদনিয়াল সেক্টরে পাকিস্তানী বাহিনী মিসাইল নিক্ষেপ করে ভারতীয় সেনাদের একটি ফাঁড়ি বা চৌকি গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলেও দাবি করেছে ইসলামাবাদ। এর পাশাপাশি আরও একটি ড্রোন গুলি করে নামানো হয়েছে, যা ভারতের পক্ষ থেকে নজরদারির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছিল বলে দাবি।
পাঁচ যুদ্ধবিমান ধ্বংসের নতুন দাবি
উল্লেখযোগ্য যে, প্রথমদিকে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তিনটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু বুধবারের বক্তব্যে খাজা আসিফ নিশ্চিত করেন যে মোট পাঁচটি যুদ্ধবিমান ধ্বংস করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মিগ-২৯ এবং দুটি সুখোই এসইউ-৩০ বলে পাকিস্তানের সামরিক মহলের একাধিক সূত্র দাবি করেছে। যদিও ভারত এখনো এসব দাবি স্বীকার করেনি।
উত্তেজনার সূচনা: জম্মু-কাশ্মিরের রক্তাক্ত হামলা
বর্তমান উত্তেজনার সূত্রপাত গত ২২ এপ্রিল। সেদিন ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মিরের পেহেলগামে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের হামলায় নিহত হয় ২৬ জন। হতাহতদের মধ্যে বেসামরিক নাগরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যও ছিল। এ হামলার জন্য ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে এবং এর প্রতিশোধ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয়।
এই ঘটনার ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায়, ৬ মে রাত ১টার দিকে পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে ভারত থেকে একাধিক মিসাইল ছোড়া হয়। পাকিস্তান দাবি করেছে, নয়াদিল্লির এই হামলায় তাদের সামরিক স্থাপনার ক্ষতি হয়েছে এবং অন্তত ৮ জন নিহত ও ৩৫ জন আহত হয়েছেন। হতাহতদের মধ্যে সাধারণ নাগরিকও রয়েছেন। পাকিস্তানের ডিরেক্টর জেনারেল অব ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) আহমেদ শরীফ চৌধুরী এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
যুদ্ধবন্দি ও পরমাণু উত্তেজনা
এতদিন শুধু বিমান ধ্বংস ও সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলার খবর এলেও, এবার খাজা আসিফ সরাসরি জানিয়েছেন যে পাকিস্তান একাধিক ভারতীয় সেনাকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক করেছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধবন্দিদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার কথা থাকলেও, এ বিষয়ে ইসলামাবাদ আর বিস্তারিত কিছু জানায়নি।
এই সংঘাতমূলক পরিস্থিতির মধ্যে অঞ্চলজুড়ে পরমাণু উত্তেজনার আশঙ্কা বাড়ছে। দুই দেশই পরমাণু অস্ত্রধারী এবং অতীতে ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধসহ একাধিকবার সীমান্ত উত্তেজনা মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছিল।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ
এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহল আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পক্ষকে দায়ী করেনি, তবে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্র থেকে অবিলম্বে উত্তেজনা কমিয়ে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি উভয় পক্ষ উত্তেজনার পথ থেকে সরে না আসে, তাহলে এই সংঘাত সীমিত সীমান্ত যুদ্ধের গণ্ডি ছাড়িয়ে বড় ধরনের দ্বন্দ্বে রূপ নিতে পারে। ভারতের পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না এলেও দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ ও জাতীয়তাবাদী প্রবণতা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করতে পারে।
যুদ্ধবিমান ধ্বংস, সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা এবং যুদ্ধবন্দির খবর—সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এক অনিরাপদ, অস্থির ভবিষ্যতের ইঙ্গিত মিলছে। সীমান্তে গোলাগুলি বা কাঁটাতার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা হয়তো প্রায়ই ঘটে, কিন্তু এবার যে মাত্রার সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আশঙ্কাজনক।
পরিস্থিতি এখন যে দিকে মোড় নেয়, তা নির্ভর করছে দুই দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কূটনৈতিক চাপ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপের ওপর। তবে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ—দুই দেশের জনগণকে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ