
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব মোকাবিলায় সংগ্রাম করে আসছে। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের জীবিকা ঝুঁকিতে পড়ে, অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর দেশের অর্থনীতিও প্রভাবিত হয়। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক একটি বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশকে দিচ্ছে ২৭০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন, যার মাধ্যমে শুধু বর্তমান বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পুনরুদ্ধারই নয়, ভবিষ্যতে দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হবে।
গত ১৫ মে বিশ্বব্যাংক তাদের নির্বাহী পরিচালক পর্ষদের অনুমোদনের কথা ঘোষণা করে, যা বাংলাদেশের টেকসই পুনরুদ্ধার, জরুরি প্রস্তুতি এবং প্রতিক্রিয়াকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ‘বি-স্ট্রং’ প্রকল্পের আর্থিক ভিত্তি স্থাপন করবে। প্রকল্পটির প্রধান লক্ষ্য হবে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের গ্রামীণ ও বন্যা সুরক্ষা অবকাঠামোর নির্মাণ ও পুনর্গঠন, যার মাধ্যমে প্রায় ১.৬ মিলিয়ন মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।
বিআই-স্ট্রং প্রকল্প শুধু মাত্র অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি গ্রহণ করবে একটি সমন্বিত ও বহুমুখী পদ্ধতি। প্রকল্পটির আওতায় জলবায়ু সহনশীল কৃষিকেও উৎসাহিত করা হবে, যা কৃষি খাতের স্থিতিশীলতা ও খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এর পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়গুলোকে জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করা হবে, যাতে তারা দুর্যোগের প্রভাব থেকে দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে পারে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর গেইল মার্টিন বলেন, “বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অভিযোজন ও দুর্যোগ প্রস্তুতিতে বিশ্বে একটি মডেল দেশ হিসেবে পরিচিত। তবে ক্রমবর্ধমান জলবায়ু ঝুঁকি ও তীব্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এই প্রকল্প দেশকে বন্যা মোকাবিলায় আরও শক্তিশালী করবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জীবনমান উন্নত করবে।”
প্রকল্পের আওতায় মোট ৭৯টি বহুমুখী বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও পুনর্বাসনের কাজ হবে। এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো শুধুমাত্র জরুরি অবস্থার জন্য নয়, বরং স্বাভাবিক সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিচালিত হবে। এ ধরনের সমন্বিত ব্যবহার সরকারি সংস্থানগুলোর কার্যকারিতা বাড়াবে এবং স্থানীয় মানুষের জন্য সুবিধাজনক পরিবেশ গড়ে তুলবে।
পৃথকভাবে বন্যা সুরক্ষা অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে বাঁধ ও খাল পুনঃখনন, সেতু ও সংযোগকারী রাস্তা মেরামত ও সংস্কার, যা বন্যার সময় অবকাঠামোগত ক্ষতি কমাবে। এছাড়া, উন্নত বন্যা পূর্বাভাস ব্যবস্থাও চালু করা হবে, যা আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতিতে সহায়ক হবে।
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ স্বর্ণা কাজী বলেন, “এই প্রকল্পটি পুনরুদ্ধার ও পুনর্গঠনের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগ স্থিতিস্থাপকতাকে সমর্থন করে। এটি শারীরিক অবকাঠামো উন্নয়ন ও অ-শারীরিক কার্যক্রম একত্রিত করে একটি সামগ্রিক পদ্ধতি গ্রহণ করবে, যা ভবিষ্যতের বন্যা ঝুঁকি হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।”
বন্যার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি খাত, যা দেশের অর্থনীতির একটি বড় অংশ। তাই প্রকল্পের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে জলবায়ু-সহনশীল ও টেকসই কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ করে কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা। উন্নত সেচ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং উন্নতমানের বীজ ও চারা সরবরাহের মাধ্যমে অন্তত ৬৫ হাজার কৃষক পরিবারের সহায়তা করা হবে।
প্রকল্পটি বীজ গ্রাম স্থাপন, গৃহস্থালি ও সম্প্রদায় বাগান উন্নয়ন এবং মহিলাদের কৃষি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ বাড়াতে কৃষক গোষ্ঠী গঠনেও কাজ করবে। এর ফলে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির মানও উন্নত হবে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক পুনর্বাসনের জন্য প্রকল্পটি নগদ-ভিত্তিক সহায়তা প্রদান করবে এবং বাজার-প্রাসঙ্গিক দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ সরবরাহ করবে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে ৩ লাখ ৮০ হাজারের বেশি মানুষ উপকৃত হবে, যারা অস্থায়ী কর্মসংস্থান সুবিধা পাবেন এবং আয়ের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।
বন্যার পুনরুদ্ধার এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগণের জীবিকা রক্ষার পাশাপাশি প্রকল্পটি পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করবে। স্থানীয় কমিউনিটিগুলোকে নৌকা, সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ ও মহড়ার মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলা হবে।
এই প্রকল্প বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রস্তুতি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে এবং বন্যার ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়িত এই উদ্যোগ দেশের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
বিশ্বব্যাংকের এই ২৭০ মিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন বাংলাদেশের বন্যা মোকাবিলায় এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু অবকাঠামো উন্নয়নই নয়, সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নত করা এবং তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা হবে। এই উদ্যোগ বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে আরও টেকসই, সহনশীল এবং প্রস্তুত রাখবে, যা জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং স্থানীয় মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণই হবে সফলতার চাবিকাঠি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ