
ছবি: সংগৃহীত
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার দীর্ঘ মেয়াদি শাসনের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্নে দৃষ্টিগ্রাহ্য কিছু সংস্কারমূলক উদ্যোগ নেওয়া হলেও, প্রায় নয় মাস পরে এসে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির চিত্রে হতাশা আর অনিশ্চয়তা ছাড়া তেমন কোনো আলোকরশ্মি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। ব্যতিক্রম হিসেবে বলা যায় কেবল রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়কে, যা আপাতভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে কিছুটা অবদান রাখলেও, সামগ্রিক আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে একেবারেই অপ্রতুল।
রেকর্ড রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের আশাবাদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে প্রবাসী আয় এসেছে ২৭৫ কোটি মার্কিন ডলার, যা একক মাসে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ। একই সময়ে রপ্তানি খাত থেকেও ৩০১ কোটি ৬৮ লাখ ডলার আয় হয়েছে, যা অনেকের কাছেই অর্থনীতির জন্য আশাবাদের বার্তা হতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ দু’টি খাত ছাড়া দেশের আর্থিক অবস্থা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়ে গেছে।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এবং দেশীয় অর্থনীতিবিদরা সকলেই সতর্ক করে বলেছেন, দেশে সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য পুনরুদ্ধারে গভীর সংস্কার ছাড়া শুধু প্রবাসী আয় বা রপ্তানির ওপর নির্ভরতা স্থায়ী সমাধান নয়।
বাজেট ও রাজস্ব ঘাটতির ভয়াবহ চিত্র
এ বছর জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্য দিয়ে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার ছিল মাত্র ৩৭ শতাংশ। এটি গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা।
এমন বিপুল ঘাটতির মুখে সরকার পরবর্তী অর্থবছরের বাজেটের আকার ছোট করতে বাধ্য হচ্ছে, যা বাংলাদেশে এক বিরল ঘটনা। এর ফলে সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অবকাঠামো খাতে ব্যয় সংকোচনের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।
ব্যাংক খাত ও শেয়ারবাজারে অস্থিরতা
আর্থিক খাতে সংস্কার আনার প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত ধীর। ব্যাংক খাতে সুশাসনের লক্ষ্যে একীভূতকরণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো কোনো কার্যকর রূপরেখা চূড়ান্ত হয়নি। ফলে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা এখনও অস্থিরতায় ভুগছে।
এদিকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটে ভুগছে বাজার। গত এক মাসে বাজার থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার মূলধন হ্রাস পেয়েছে, যা মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঞ্চয়ের ওপর বড় আঘাত হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং নিয়ন্ত্রণহীনতা এর পেছনে অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
মূল্যস্ফীতি, আয় ও ব্যয়ের বৈষম্য
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সম্প্রতি জানিয়েছে, গত ২৬ মাসে মূল্যস্ফীতির হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসেছে। তবে সেটি এখনও দুই অঙ্কের কাছাকাছি অবস্থান করছে। সরকার যেখানে বার্ষিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে ৬.৫ শতাংশ, সেখানে বাস্তব পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক বেশি।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি এ বছর ৩.৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন হতে পারে। একই সঙ্গে আরও ৩০ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি।
শিল্প খাতে আস্থা সংকট ও কর্মসংস্থানের অবনতি
শিল্প ও ব্যবসায় বিনিয়োগে স্থবিরতা অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং প্রশাসনিক হয়রানির অভিযোগে অনেক বড় শিল্পগোষ্ঠী বিনিয়োগ থেকে সরে আসছে। ঢাকার চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান স্পষ্টই বলেছেন, "অকারণে কোনো ব্যবসায়ীকে হয়রানি করা হলে শিল্প-ব্যবসা আরও অস্থির হয়ে পড়ে।"
এর প্রভাবে গত আট মাসে কয়েক হাজার ছোট-বড় কারখানা বন্ধ হয়েছে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি না হয়ে বরং প্রতিদিন বহু মানুষ চাকরি হারাচ্ছেন। তৈরি পোশাক রপ্তানি খাত, যা দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস ছিল, সেই খাতও এখন তীব্র সংকটে।
আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক ও দ্বৈত ভাষা
রিজার্ভ বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ২৭ বিলিয়ন ডলার, যা দেখে সরকার মনে করছে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সাহায্য ছাড়াই পথ চলা সম্ভব। ফলে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্রকল্পের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড়ে অনীহা দেখাতে শুরু করেছে তারা।
তবে একই সময়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে দেনদরবার চালিয়ে যাওয়া এই অবস্থানকে দ্বিচারিতা হিসেবে দেখছেন অনেকে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের অবদানকে অস্বীকার করা বাস্তববিবর্জিত বলেও মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকরা।
রাজনৈতিক বাস্তবতা ও ভবিষ্যতের শঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চীন-আমেরিকার বাণিজ্যযুদ্ধ এবং ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত পরিস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। বাণিজ্য ঘাটতি আরও বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে। যদিও সরকার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো দীর্ঘমেয়াদি এবং তাৎক্ষণিক ফল দেবে না।
বিশ্লেষকদের মন্তব্য: আত্মতুষ্টির ফাঁদে সাবধান
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “রিজার্ভ, রপ্তানি, রেমিট্যান্সের চিত্র ভালো হলেও রাজস্ব ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি, বাজেট বাস্তবায়ন ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির সংকটগুলোর গভীরতা অনুধাবন না করলে সরকারের আত্মতুষ্টি অর্থনীতির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”
তিনি আরও বলেন, “আগের সরকার যেভাবে আর্থিক খাতের বাস্তব সংকট আড়াল করে ফাঁপা উন্নয়ন তুলে ধরেছিল, সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি করলে বর্তমান সরকারও ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারবে না।”
নতুন সরকার এক নতুন আশার বার্তা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও, নয় মাস পর এসে দেশের অর্থনীতি যে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে তা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। আত্মতুষ্টি নয়, প্রয়োজন এখন বাস্তবভিত্তিক নীতিগত সংস্কার ও নির্ভরযোগ্য আর্থিক কাঠামো গড়ে তোলা। না হলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের সাময়িক অর্জন খুব দ্রুতই ঢেকে দেবে একটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক বিপর্যয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ