ছবি: সংগৃহীত
দেশজুড়ে কর প্রশাসনকে আরও কার্যকর ও স্বচ্ছ করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি ডিসেম্বর মাসে ৫০ হাজার নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাটের আওতায় আনার একটি বড় উদ্যোগ নিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট ব্যবস্থার আওতা বৃদ্ধির চেষ্টা থাকলেও এর মতো সুসংগঠিত ও লক্ষ্যভিত্তিক ক্যাম্পেইন সাম্প্রতিক সময়ে আর দেখা যায়নি। এনবিআর কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য করদাতাদের ভয় দেখানো নয়, বরং স্বেচ্ছায় ভ্যাট প্রদানকে উৎসাহিত করা, যাতে ব্যবসায়ীরা নিয়মিত মাসিক রিটার্ন দাখিল করতে আগ্রহী হন এবং কর প্রশাসন আরও শক্তিশালী হয়।
ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ সামনে রেখে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা
প্রতিবছরের মতো এবারও ১০ ডিসেম্বর ভ্যাট দিবস এবং ১০ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভ্যাট সপ্তাহ পালন করা হবে। তবে এ বছর রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ও কর ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে আয়োজনগুলো আরও সম্প্রসারিত ও বাস্তবভিত্তিক হচ্ছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
এই উপলক্ষে ১০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের সব ভ্যাট কমিশনারেট, বিভাগ ও সার্কেলে বিশেষ সেবা বুথ স্থাপনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাজার, শপিংমল ও ব্যবসায়িক এলাকাগুলোতে ভ্রাম্যমাণ টিম কাজ করবে, যাতে অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি তাৎক্ষণিক ভ্যাট নিবন্ধন পেতে পারে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা ভ্যাট সংক্রান্ত যেকোনো জটিলতা বা অভিযোগের তাৎক্ষণিক সমাধান পাবেন এবং প্রতিটি সমাধানের রিপোর্ট এনবিআরে পাঠানো হবে।
একজন ভ্যাট কমিশনার এ উদ্যোগকে “ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের নতুন আস্থা-সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা” বলে অভিহিত করেন।
ভ্যাট নিবন্ধন ৬ লাখ থেকে সাড়ে ৬ লাখে: এনবিআরের লক্ষ্য
বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত সক্রিয় ভ্যাটদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ডিসেম্বরের ক্যাম্পেইন শেষে এই সংখ্যা সাড়ে ৬ লাখে উন্নীত করার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। ইতোমধ্যে সব ভ্যাট কমিশনারেটকে লিখিত নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে এবং মাঠ পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন: “আমরা কাউকে জোর করে নিবন্ধনের আওতায় আনছি না। ব্যবসায়ীরা নিজেরাই যখন স্বেচ্ছায় আসে, তখন তারা নিয়ম মেনে চলে। এটাই আমাদের লক্ষ্য।”
ভ্যাট ব্যবস্থার পটভূমি: তিন দশকের যাত্রা
বাংলাদেশে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর চালু হয় ১৯৯১ সালের ১ জুলাই, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর পরামর্শে। এর আগে দেশে বিক্রয় কর (Sales Tax) প্রথা চালু ছিল, যা ছিল অপেক্ষাকৃত সীমিত ও খাতভিত্তিক।
ভ্যাট আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল—
রাজস্ব আহরণকে সহজ করা
কর ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও আধুনিক করা
উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহব্যবস্থাকে কর কাঠামোর আওতায় আনা
পর্যায়ক্রমে খাতভিত্তিক কর নির্ভরতা কমানো
প্রথমদিকে কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে ভ্যাট আরোপ করা হলেও পরবর্তী তিন দশকে এর পরিধি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এখন প্রায় সব ধরনের পণ্য ও সেবা কোনো না কোনোভাবে ভ্যাটের আওতায় রয়েছে।
রাজস্বে ভ্যাটের অবদান: স্থিতিশীল কিন্তু চ্যালেঞ্জপূর্ণ
এনবিআরের মোট রাজস্বের প্রায় ৩৭ শতাংশ আসে ভ্যাট থেকে—যা কর ব্যবস্থার সর্বোচ্চ একক উৎস। বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও ভ্যাটকে টেকসই রাজস্ব আহরণের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে আমদানি নির্ভর অর্থনীতিতে ভ্যাট আদায় তুলনামূলকভাবে সহজ এবং চাপও কম।
গত কয়েক বছরে ভ্যাট আদায় ধারাবাহিকভাবে বাড়লেও এখনও প্রাপ্ত সম্ভাবনার তুলনায় এটি অনেক কম বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, বড় চ্যালেঞ্জগুলো হলো—
অনেক ব্যবসা ভ্যাট নিবন্ধনের বাইরে
মাসিক রিটার্ন জমা দেওয়ার হার কম
ই-ভ্যাট সিস্টেম পুরোপুরি কার্যকর হয়নি
অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে এখনো বড় অংশ অনানুষ্ঠানিক
এ কারণেই এনবিআরের এবারের ৫০ হাজার নতুন ভ্যাটদাতা আনার উদ্যোগকে তারা ‘সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখছেন।
শীর্ষ ভ্যাটদাতাকে সম্মাননা বন্ধ—পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের প্রভাব
ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শীর্ষ করদাতাদের সম্মাননা প্রদান একটি নিয়মিত প্রথা হলেও বাংলাদেশে গত বছর থেকে এই রেওয়াজ বন্ধ আছে। গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের কারণে এনবিআর এই আয়োজন থেকে সাময়িকভাবে সরে আসে।
এ বছরও সর্বোচ্চ মূসক পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠানকে কোনো পুরস্কার বা ক্রেস্ট দেওয়া হবে না—কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে—
পুরস্কার পাওয়ার পদ্ধতিতে অস্পষ্টতা
শ্রেণিবিভাগের মানদণ্ড নিয়ে বিতর্ক
নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কারের প্রয়োজন
এনবিআর জানিয়েছে, নতুন মানদণ্ড নির্ধারণের কাজ চলছে এবং ভবিষ্যতে আরও স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ কাঠামো তৈরি করা হবে।
কমিটি গঠন ও সাম্প্রতিক বৈঠক: উদযাপন প্রস্তুতি জোরদার
ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ ২০২৫ উদযাপন উপলক্ষে এনবিআর গত নভেম্বর মাসে ৯ সদস্যের কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করে। চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
কমিটির অন্যান্য সদস্যরা কাস্টমস, বন্ড, আইটি, ভ্যাট প্রশাসন, নীতি প্রণয়ন, অডিট ও গোয়েন্দা শাখার সদস্য-স্তরের কর্মকর্তারা। সম্প্রতি উদযাপন উপ-কমিটির দ্বিতীয় সভায় পুরো মাসব্যাপী কর্মসূচি, বুথ ব্যবস্থাপনা, প্রচার কার্যক্রম ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর রণকৌশল চূড়ান্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত: ‘ভ্যাট পরিকল্পনায় নতুন দিকচিহ্ন’
অর্থনীতি ও কর প্রশাসন বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন—
৫০ হাজার নতুন নিবন্ধন বাস্তবায়িত হলে করদাতা বেস উল্লেখযোগ্যভাবে বিস্তৃত হবে।
স্বেচ্ছা নিবন্ধন নীতি চাপ এড়াতে সাহায্য করবে।
অনলাইন ভ্যাট সিস্টেম (ই-ভ্যাট) আরও কার্যকর করতে হবে।
বাজার পর্যায়ে নজরদারি বাড়ানো জরুরি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)-এর এক সাবেক পরিচালক বলেন— “মাঝারি ও ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য ভ্যাট নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করা ও সেবা বুথ স্থাপন বড় ইতিবাচক উদ্যোগ। তবে এরপরও ব্যবসায়ীদের রিটার্ন দাখিলে উত্সাহিত করতে টেকনিক্যাল সাপোর্ট আরও বাড়াতে হবে।”
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা: টেকসই রাজস্ব কাঠামোর পথে আরও এক ধাপ
এনবিআর কর্মকর্তারা মনে করছেন, ডিসেম্বরের নিবন্ধন ক্যাম্পেইন সফল হলে ভবিষ্যতে—
দেশব্যাপী ডিজিটাল ভ্যাট রসিদ (eFD) প্রবর্তন
ব্যবসায়ীদের জন্য মোবাইল অ্যাপভিত্তিক রিটার্ন
বাজার এলাকাভিত্তিক ঝুঁকি-ভিত্তিক অডিট সিস্টেম
অনলাইন হেল্পডেস্ক ও ২৪/৭ ভ্যাট সাপোর্ট
চালু করা সহজ হবে।
বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি, অবকাঠামো ও বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা কমাতে টেকসই রাজস্ব জরুরি। ভ্যাট ব্যবস্থার উন্নয়নকে সেই দিকেই এগিয়ে যাওয়ার বড় পদক্ষেপ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



