ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রামে দুই সৎ ও নিষ্ঠাবান রাজস্ব কর্মকর্তার ওপর সংঘটিত পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় গভীর ক্ষোভ, নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অবৈধ পণ্য খালাসে বাধা ও রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় এই হামলার লক্ষ্যবস্তু হন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে কর্মরত দুই কর্মকর্তা—রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান খান এবং মো. বদরুল আরেফিন ভূঁইয়া। এ ঘটনায় অজ্ঞাত তিন দুষ্কৃতিকারীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে এবং অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে এনবিআর।
এনবিআর থেকে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) রাতে পাঠানো এক সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সেদিন সকাল ১০টা ২০ মিনিটের দিকে দুই কর্মকর্তা দাপ্তরিক কাজে চট্টগ্রাম কাস্টমস গোয়েন্দা আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে নিজ দপ্তর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ফেরার পথে হামলার শিকার হন।
চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানাধীন সিডিএ আবাসিক এলাকায় আচমকা মোটরসাইকেলযোগে তিনজন মুখোশধারী বা অজ্ঞাত দুষ্কৃতিকারী তাদের গাড়ির সামনে এসে পথরোধ করে। এরপর প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে চাপাতি দিয়ে গাড়িতে আক্রমণ চালায়। গাড়ির বাম পাশের কাচ লাথি মেরে ভেঙে ফেলা হয় এবং হামলাকারীরা ‘গুলি কর, গুলি কর’—এই ধরনের নির্দেশমূলক চিৎকার করতে থাকে, যা স্পষ্টত একটি সুপরিকল্পিত হত্যাচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়।
জীবন বাঁচাতে দুই কর্মকর্তা পরিস্থিতি বুঝে দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে অফিসের দিকে চলে আসতে সক্ষম হন। ঘটনার পরদিন ডবলমুরিং মডেল থানায় মো. আসাদুজ্জামান খান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
এনবিআর জানিয়েছে, সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস রাজস্ব ফাঁকি রোধে অত্যন্ত কার্যকর ও কঠোর নজরদারি চালাচ্ছে। এতে একাধিক শক্তিশালী চোরাচালানচক্র, জালিয়াতি সিন্ডিকেট এবং বেআইনি আমদানিকারক গোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই চক্রগুলোই হামলার পেছনে রয়েছে।
গত কয়েক মাসে কাস্টম কর্মকর্তােরা নিম্নোক্ত উল্লেখযোগ্য পণ্য আটকের ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন— প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যের আমদানি নিষিদ্ধ পপি সিড ও ঘন চিনি আটক, প্রায় ৩০ কোটি টাকা মূল্যের নিষিদ্ধ সিগারেটের চালান জব্দ, চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন শেডে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আনা কসমেটিকস পণ্যের চালান জালিয়াতি চক্র থেকে উদ্ধার।
এনবিআর জানায়, এসব পণ্য আটকের পর থেকেই কর্মকর্তাদের ওপর হুমকি বাড়ে। গত ৫ অক্টোবর বিকেল সাড়ে চারটায় মো. আসাদুজ্জামান খানকে ব্যক্তিগত হোয়াটসঅ্যাপে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা কল দিয়ে ভয়ভীতি ও খুনের হুমকি দেয়। পরদিন তিনি চট্টগ্রাম বন্দর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এনবিআর স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করে— “নিষ্ঠার সঙ্গে রাজস্ব ফাঁকি রোধ, নিষিদ্ধ পণ্য আটক ও সঠিক শুল্ক আদায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের ওপর এ হামলা অত্যন্ত ঘৃণ্য, নিন্দনীয় ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম।”
এনবিআর আরও জানায়— সৎ, পরিশ্রমী ও দেশপ্রেমিক রাজস্ব কর্মকর্তাদের সকল প্রকার নিরাপত্তা নিশ্চিতে এনবিআর অঙ্গীকারবদ্ধ।
হামলাকারীরা যতই শক্তিশালী, প্রভাবশালী বা সংগঠিত হোক—কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
যত দ্রুত সম্ভব তাদের শনাক্ত, গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে।
ঘটনার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে এনবিআর আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করেছে— মামলার দ্রুত তদন্ত, সকল জড়িত ব্যক্তিকে শনাক্তকরণ, এবং কোনো ধরনের প্রভাব বা বাইরের চাপ ছাড়াই অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য।
একইসঙ্গে দেশের বন্দর, কাস্টমস, গোয়েন্দা ও রাজস্ব সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা জোরদারের জন্য অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়েও সুপারিশ করা হয়েছে।
হামলার পর রাজস্ব কর্মকর্তা ও কাস্টম কর্মীদের মধ্যে শঙ্কা ও ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তবে এনবিআর বলেছে, “এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা সৎ কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙে দিতে পারবে না। বরং রাজস্ব ফাঁকি রোধে চলমান কার্যক্রম আরও জোরদার করা হবে।”
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা জানান, অবৈধ পণ্য আটকের পর সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেটগুলো বহুবার বিভিন্ন কৌশলে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু কর্মকর্তারা নীতিমালা অনুযায়ী কাজ করায় তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়।
চট্টগ্রামে দুই রাজস্ব কর্মকর্তার ওপর বর্বরোচিত হামলা শুধু দু’জন সরকারি কর্মচারীর ওপর আক্রমণ নয়—এটি দেশের রাজস্ব নিরাপত্তা, শুল্ক ব্যবস্থা এবং আইনের শাসনের ওপর চ্যালেঞ্জ। এনবিআর তাই এই হামলাকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড’ বলে অভিহিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
অবৈধ ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যারা দেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কাজ করছে—এনবিআর তাদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে এক অনিবার্য বার্তা দিয়েছে: সত্য ও সততা আক্রমণের মুখে নত হবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



