ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ও রাজধানীর কেরানীগঞ্জে অবস্থিত পানগাঁও নৌ টার্মিনাল দীর্ঘমেয়াদি ইজারায় বিদেশি অপারেটরদের হাতে তুলে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত ঘিরে সারা দেশে এক বিস্তৃত রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। বাম থেকে ডান—সব মতাদর্শের রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠন, নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, শিক্ষার্থী সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক সমাজ একযোগে রাস্তায় নেমেছে। দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর—সরকারি ভাষায় “উন্নয়ন সহযোগিতা” হলেও আন্দোলনকারীরা এটিকে “সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হুমকি” হিসেবে দেখছেন।
চট্টগ্রাম থেকে শুরু হওয়া ক্ষোভ অল্প সময়েই ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে। বন্দর রক্ষায় শ্রমিক সংগঠনগুলো একত্রিত হয়েছে; পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে বাম দলগুলো যেসব দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিল, এবার সেই আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে ডানপন্থী দল ও ডানঘরানার শ্রমিক সংগঠনও। আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি দেখে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী সপ্তাহেই হরতাল-অবরোধ এবং ‘যমুনা ঘেরাও’–এর মতো উচ্চমাত্রার কর্মসূচি ঘোষিত হতে পারে।
গোপন চুক্তির অভিযোগ: ছাত্রসমাজও সক্রিয়
বুধবার বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। তাদের অভিযোগ—সরকার গোপনীয়ভাবে, জনমতের তোয়াক্কা না করে, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে ৩০ বছর বা তার বেশি মেয়াদি চুক্তি করছে, যা দেশের অন্যতম কৌশলগত স্থাপনা চট্টগ্রাম বন্দরের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে জনগণকে অন্ধকারে রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার শামিল।
গত সোমবার সরকারের সঙ্গে তিনটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির দুটি বড় চুক্তি হয়—
(১) ডেনমার্কের APM Terminals—যারা লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করবে।
(২) সুইজারল্যান্ডের Medlog SA—যারা পানগাঁও নৌ টার্মিনালের দায়িত্ব নেবে।
সরকার আরও কয়েকটি টার্মিনাল হস্তান্তরের প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে। সবচেয়ে আলোচিত হলো নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)—যা চট্টগ্রাম বন্দরের মোট কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ৪৪ শতাংশ পরিচালনা করে। এটিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছে হস্তান্তরের জন্য দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠনের প্রস্তাব ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে।
এনসিটি-সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতের মৌখিক স্থিতাবস্থা থাকা সত্ত্বেও ১৬ নভেম্বর নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগকে আন্দোলনকারীরা এবং আইনজীবীরা “আদালত অবমাননা” বলে দাবি করছেন। যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন এ বিষয়ে রিট করেছেন।
বিদেশি নিয়ন্ত্রণের ইতিহাস: দীর্ঘ অস্থিরতার ধারাবাহিকতা
পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকেই টার্মিনাল ব্যবস্থাপনায় বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ, পতেঙ্গা টার্মিনাল সৌদি কোম্পানির হাতে দেওয়া এবং এনসিটি পরিচালনায় দুবাইভিত্তিক কোম্পানি আনতে উদ্যোগ নেওয়ার মতো ঘটনা বিতর্ক সৃষ্টি করে। সেই বিতর্ক অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আবারও তীব্র আকার নিয়েছে।
শ্রমিক সংগঠনগুলো বলছে, পাঁচটি টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের হাতে গেলে বন্দরের মোট ব্যবস্থাপনার বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের বাইরে চলে যাবে। ফলে কনটেইনার হ্যান্ডলিং, সময়সূচি নির্ধারণ, শুল্কের প্রস্তাব, অপারেশনাল খরচ নির্ধারণসহ নানা কৌশলগত বিষয়ের ওপর বিদেশি প্রতিষ্ঠান প্রভাব বিস্তার করবে, যা দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্যব্যবস্থা ও সামগ্রিক নিরাপত্তাকে গুরুতর ঝুঁকিতে ফেলবে।
রাজপথে উত্তাল বিক্ষোভ: স্কপের কঠোর কর্মসূচির হুমকি
বুধবার চট্টগ্রামে ‘চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষা পরিষদ’ বিশাল মশাল মিছিল করে। আজ বৃহস্পতিবারও একাধিক সংগঠনের বিক্ষোভ রয়েছে। শনিবার স্কপ আয়োজিত জাতীয় কনভেনশন থেকে ঘোষণা আসতে পারে—
-
হরতাল
-
ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাংক রোড অবরোধ
-
অন্তর্বর্তী সরকারের বাসভবন যমুনা ঘেরাও
-
লাগাতার হরতাল বা অবরোধ
স্কপের যুগ্ম সমন্বয়ক রিজওয়ানুর রহমান খান বলেন, “স্টেকহোল্ডারদের মতামত ছাড়াই এ চুক্তি হয়েছে। জনগণ এই অস্বচ্ছ চুক্তি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছে। চুক্তি বাতিল না হলে আমাদের আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে।”
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ জানান, ২১ তারিখ থেকে দেশব্যাপী বিক্ষোভ, পদযাত্রা ও গণসংযোগ চলবে। তিনি সতর্ক করেন—সরকার দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানালে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ‘যমুনা ঘেরাও’–সহ আরও কঠোর কর্মসূচি আসবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা সাইফুল হক বলেন, “জনমত উপেক্ষা করে করা এসব চুক্তি স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের প্রতিফলন। মাত্র তিন মাস মেয়াদি সরকার কেন এত তাড়াহুড়ো করে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলবে?”
বাম থেকে ডান—সবাই এক ব্যানারে
এই ইস্যুতে যে রাজনৈতিক বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে, তা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যায়নি। একই দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে—
-
স্কপ ও জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল
-
কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
-
বাসদ ও বাম গণতান্ত্রিক জোট
-
গণসংহতি আন্দোলন
-
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি
-
বাংলাদেশ জাসদ
-
জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট
-
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
-
বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ১২ দলীয় জোট
-
জামায়াতে ইসলামী
-
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
এদের প্রত্যেকেই আলাদা বিবৃতিতে টার্মিনাল ইজারা চুক্তিকে “গণবিরোধী, স্বার্বভৌমত্ববিরোধী এবং বিপদজনক” বলেছে।
হেফাজতের আমির মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী জানিয়েছেন, “বন্দর আমাদের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। বিদেশিদের কাছে এটি তুলে দেওয়ার যেকোনো পদক্ষেপ জাতীয় নিরাপত্তার ওপর সরাসরি হুমকি।”
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি বলেছে, “চুক্তির শর্ত গোপন রেখে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। চুক্তি প্রকাশ ও জনমতের অনুমোদন বাধ্যতামূলক।”
“সার্বভৌমত্বের গলার কাঁটা” — বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য জোটের উদ্বেগ
১২ দলীয় জোটের নেতারা বিবৃতিতে বলেছেন, “এ ধরনের সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে দেশের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। চট্টগ্রামসহ দেশের সব কৌশলগত বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দিলে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা ধ্বংস হবে।”
জামায়াতে ইসলামীর চট্টগ্রাম জোনাল হেড মুহাম্মদ শাহজাহান বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। অস্বচ্ছ ও তাড়াহুড়াপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া চরম দায়িত্বহীনতা।”
আন্দোলনের ভবিষ্যৎ: পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দেশের সব মতাদর্শের দল একসঙ্গে রাস্তায় নামা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আন্দোলনটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। বন্দর ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনীতিকেও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের রপ্তানি-আমদানি প্রবাহের ৯০ শতাংশই এই বন্দরের মাধ্যমে হয়। ফলে টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশি নিয়ন্ত্রণ থাকলে—
-
কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে দেশ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে
-
আর্থিক ক্ষতি হতে পারে
-
শ্রমিক নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান সংকটে পড়তে পারে
-
জরুরি সময়ে (যুদ্ধ/অবরোধ/রাজনৈতিক উত্তেজনা) জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে
সার্বিক পরিস্থিতি
দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর কীভাবে পরিচালিত হবে—তা বাংলাদেশের হাজার হাজার ব্যবসায়ী, শ্রমিক, আমদানিকারক, রপ্তানিকারক, নিরাপত্তা সংস্থা এমনকি সাধারণ মানুষের স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া “অস্বচ্ছ, তাড়াহুড়াপূর্ণ এবং জনগণের সম্পৃক্ততাহীন”—এই অভিযোগই আন্দোলনের মূল ভিত্তি।
এ মুহূর্তে আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে এবং আগামি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আন্দোলনের বিস্তার ও বহুমাত্রিক সমালোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে, আর চুক্তিগুলোর ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



