ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ১৬ কর্মকর্তার অস্বাভাবিক সম্পদ-অর্জন, আয়কর নথির অসংগতিসহ সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে অনুসন্ধান শুরু করেছে, তা এখন নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। দুদকের নিয়োজিত বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যেই অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছেন। তদন্তের প্রাথমিক ধাপে সম্পদ বিবরণী যাচাই, বিদেশ যাত্রা নিষেধাজ্ঞা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিঠি পাঠানোসহ বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা সরকারী দুর্নীতি দমনের চলমান প্রচেষ্টায় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
দুদক জানিয়েছে—এনবিআরের ১৬ কর্মকর্তা ইতোমধ্যে তাদের সম্পদের তালিকা জমা দিয়েছেন। এখন দেখা হচ্ছে, তাদের উপস্থাপিত সম্পদের বিবরণ আয়কর নথিতে দেখানো তথ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি না। যদি কোনো সম্পদ আয়করে উল্লেখ না থাকে অথবা আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়—তাহলে তার উৎস নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত অনুসন্ধান করা হবে।
এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, ব্যাংক, রেজিস্ট্রি অফিস, সিটি করপোরেশন, ভূমি অফিসসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানে তথ্য আদায়ের জন্য চিঠি পাঠানো হচ্ছে। প্রয়োজনে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হতে পারে। একই সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনের নামে সম্পদের লেনদেন বা হস্তান্তর হয়েছে কি না, সেটিও যাচাই করা হবে।
দুদক আরও জানিয়েছে—লোকমান আহমেদ নামের এক কর্মকর্তাকে শিগগিরই সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হবে।
যে কর্মকর্তাদের সম্পদ যাচাই করছেন দুদকের অনুসন্ধানকারী টিম
দুদক কর্মকর্তারা ১৬ জনের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা অনুসন্ধান করছেন। তাদের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছে নিম্নরূপঃ
-
মো. লুৎফুল আজীম (সদস্য, আন্তর্জাতিক কর): উপপরিচালক মো. ইয়াসির আরাফাত
-
এম এম ফজলুল হক (সাবেক সদস্য, কর জরিপ ও পরিদর্শন): সহকারী পরিচালক পিয়াস পাল
-
এ কে এম বদিউল আলম (সদস্য, কর লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট): সহকারী পরিচালক পিয়াস পাল
-
আব্দুল রশিদ মিয়া (কাস্টমস–ভ্যাটের অতিরিক্ত কমিশনার): সহকারী পরিচালক পিয়াস পাল
-
মো. আলমগীর হোসেন (সাবেক সদস্য, কর অডিট ও গোয়েন্দা): সহকারী পরিচালক মিনহাজ বিন ইসলাম
-
মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দিন খান (যুগ্ম কর কমিশনার): সহকারী পরিচালক এ কে এম মর্তুজা আলী সাগর
-
মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম (উপ কর কমিশনার): সহকারী পরিচালক এ কে এম মর্তুজা আলী সাগর
-
মির্জা আশিক রানা (অতিরিক্ত কর কমিশনার): উপসহকারী পরিচালক আবু মোহাম্মদ আনোয়ারুল মাসুদ
-
সেহেলা সিদ্দিকা (অতিরিক্ত কর কমিশনার): উপসহকারী পরিচালক মিনু আক্তার সুমি
-
মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা (উপ কর কমিশনার): উপসহকারী পরিচালক মিনু আক্তার সুমি
-
হাছান তারেক রিকাবদার (অতিরিক্ত কমিশনার, কাস্টমস–ভ্যাট): সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম
-
মো. মামুন মিয়া (অতিরিক্ত কমিশনার, কাস্টমস–ভ্যাট): সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম
-
সাধন কুমার কুণ্ডু (অতিরিক্ত কমিশনার, বিশেষ ভি.ও.): সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন
-
তারেক হাসান (যুগ্ম কমিশনার, কাস্টমস–ভ্যাট): উপপরিচালক মো. আল আমিন
-
কাজী মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন (কাস্টমস কমিশনার): সহকারী পরিচালক নাসরুল্লাহ হোসাইন
-
মো. কামরুজ্জামান (সদস্য, কাস্টমস আপিল ট্রাইব্যুনাল): সহকারী পরিচালক আসিফ আল মাহমুদ
অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব এত বিস্তৃতভাবে বণ্টন করায় দুদকের তদন্ত যে দীর্ঘ ও গভীর হবে—তা স্পষ্ট।
দুদকের অনুসন্ধান চলাকালে কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিদেশ যাত্রায় সম্ভাব্য পলায়ন ঝুঁকি পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানের স্বার্থে এ পর্যন্ত আদালত তিনজন কর্মকর্তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন—
-
এ কে এম বদিউল আলম
-
এম এম ফজলুল হক
-
আব্দুল রশিদ মিয়া
আদালতে দুদক জানিয়েছে—অভিযুক্তরা বিদেশে পলায়ন করতে পারেন এমন বিশ্বস্ত তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান বাধাগ্রস্ত না করতে তাদের বিদেশযাত্রা বন্ধ করা জরুরি।
এর প্রেক্ষাপটও যথেষ্ট আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সরকার যখন এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি নতুন বিভাগ—কর বিভাগ এবং কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট বিভাগ—গঠনের ঘোষণা দেয়, তখনই এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলনে নামেন। আন্দোলনের শেষ দিকে হঠাৎ করেই দুদক এই ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের ঘোষণা দেয়, যা আন্দোলনরত কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়।
অনেকের মতে, এনবিআরের কাঠামোগত পরিবর্তন এবং অভ্যন্তরীণ বিরোধের মধ্যেই দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে ত্বরান্বিত করা হয়েছে। তবে দুদক বলছে—এটি সম্পূর্ণ প্রমাণভিত্তিক ও নথিভুক্ত অভিযোগের ভিত্তিতে নেওয়া নিয়মিত তদন্ত।
দুদক জানিয়েছে—প্রয়োজনে আরও কর্মকর্তাকে অনুসন্ধানের আওতায় আনা হতে পারে এবং যাদের সম্পদের অসঙ্গতি পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। এমনকি তদন্ত চলাকালে অন্য কর্মকর্তাদেরও বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে।
কেন এই অনুসন্ধান গুরুত্বপূর্ণ
-
এনবিআর দেশের রাজস্ব আহরণের প্রধান সংস্থা
-
দরপত্র, আমদানি–রপ্তানি, কাস্টমস মূল্যায়ন—সবক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের ব্যাপক ক্ষমতা
-
অতীতে একাধিকবার এনবিআর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে
-
রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
এই বাস্তবতায় ১৬ কর্মকর্তার সম্পদ অনুসন্ধানকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে বড় ধরনের স্বচ্ছতা আনার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দুদকের এই বিস্তৃত অনুসন্ধান শুধু এনবিআরের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে সরকারি আমলাতান্ত্রিক কাঠামোর জন্যও এক বড় বার্তা বহন করছে—দায়িত্বশীল পদে থেকে অস্বাভাবিক সম্পদ-অর্জন, নথি গোপন, অবৈধ লেনদেন—কোনো কিছুই এখন আর তদন্তের বাইরে থাকবে না।
এই তদন্তের অগ্রগতি এবং পরবর্তী ধাপগুলো এখন দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে গভীর নজরদারির আওতায় রয়েছে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



