ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সামগ্রিক সংকট নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ—সবাই এককথায় যে সমস্যাটির কথা বলেন, তা হলো চাঁদাবাজি। রাজনৈতিক মতভেদ, নির্বাচন, ক্ষমতার পালাবদল—এসব বিষয়ে সমাজে তীব্র বিভাজন থাকলেও চাঁদাবাজিমুক্ত দেশের দাবি আজ অদ্বিতীয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো—চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখালেও, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে কেউ আগ্রহী নন। রাজনৈতিক আশ্রয়–প্রশ্রয়ে চাঁদাবাজি এখন এক ভয়ংকর ব্যাধির রূপ নিয়েছে, যার সামনে অসহায় সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে দেশের শিল্প-বাণিজ্য খাত।
চাঁদাবাজির লাগামহীন বিস্তার: রাজনীতি, প্রশাসন, সমাজ—সবখানে প্রভাব
চাঁদাবাজি আজ কোনো একটি শ্রেণি বা অঞ্চলের সমস্যা নয়; বরং এটি রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী—সবক্ষেত্রে এক অঘোষিত নেটওয়ার্ক হিসেবে বিস্তৃত। রাজনৈতিক দলগুলো প্রকাশ্যে বা গোপনে চাঁদাবাজদের ছত্রছায়া দিয়ে আসছে বহু বছর। ফলে এই গোষ্ঠীগুলো এখন প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। সাধারণ মানুষ ভয় পায়, আর পুলিশ–প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে বিষয়টি এড়িয়ে যায় বা উদাসীন থাকে।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষ স্বস্তির আশায় ছিল—হয়তো এবার চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য কমবে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা না কমায়, বরং পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন—চাঁদাবাজি এখন “অপরিমেয়” মাত্রায় পৌঁছেছে।
ব্যবসায়ীদের আর্তনাদ: আয় কমে গেছে, চাঁদা বেড়ে গেছে দশগুণ
দেশের অর্থনীতি গত দেড় বছর ধরে নাজুক অবস্থায়। এই অবস্থায় চাঁদাবাজির অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার ব্যবসাবাণিজ্যকে প্রায় অচল করে তুলছে। আগে বছরে কয়েক বার চাঁদা দিতে হতো; এখন একেক ব্যবসায়ীকে একাধিক জায়গায়, একাধিক গোষ্ঠীকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হচ্ছে।
এফবিসিসিআই আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা একবাক্যে বলেছেন—
-
ট্রাক লোড–আনলোড, বন্দর থেকে পণ্য খালাস—সব জায়গায় চাঁদা
-
পরিবহনে মোড়–মোড়, চেকপোস্ট, রাজনৈতিক গোষ্ঠী—সবখানে হাত
-
চাঁদা না দিলে ব্যবসা, গুদাম বা পরিবহন নিরাপদ থাকে না
-
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের সঙ্গে চাঁদাবাজদের ঘনিষ্ঠতা আছে
রমজানের আগে নিত্যপণ্যের দামের ওপর এর ভয়াবহ প্রভাব পরবে বলেও তারা সতর্ক করেন।
এফবিসিসিআই প্রশাসকের বক্তব্য—“সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে অনুরোধ করা হবে”—ব্যবসায়ীদের হতাশ করেছে। তাদের মতে, এভাবে অনুরোধে সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়; দরকার কঠোর রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শিল্পোদ্যোক্তা—কেউ রক্ষা পাচ্ছে না
ফুটপাতের দোকানি শামসুল হকের গল্প
কারওয়ান বাজারের ছোট দোকানি শামসুল হক মণি প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০ টাকা চাঁদা দিতে বাধ্য হন। তাঁর দৈনিক আয় ১,৫০০ টাকার মতো। তিন ভাগের এক ভাগ টাকা চাঁদায় গেলে পরিবারের খরচ চলে না—এটাই তাঁর আর্তি।
তিনি স্পষ্ট বলেন—
“চাঁদা না দিলে দোকান বসতে দেবে না। তাই বাধ্য হয়ে দিই। আর এই চাঁদাই জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়।”
এ চিত্র দেশের সব বাজারেই একই।
মাঝারি ব্যবসায়ীর দুঃসহ অভিজ্ঞতা
ট্রাভেল এজেন্সির মালিক আমিনুলের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা—৫ আগস্টের পর একদল তরুণ তাঁর কাছে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। অস্বীকার করলে অফিসে হামলা হয়। থানায় গেলে পুলিশ জানায়—“এ বিষয়ে কিছু করার নেই।” তিনিই আজ ব্যবসা বন্ধ করে ঘরে বসে।
শিল্পকারখানায় সহিংসতা
গত ১৫ মাসে—
-
২৭৮টি শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজদের হামলা
-
৬৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ
-
বহু প্রতিষ্ঠান নীরবে চাঁদা দেয়, অভিযোগও করে না
একজন গার্মেন্টস মালিক বলেন—
“চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই বিপদ। তাই নীরবে সহ্য করি।”
ঘরে, রাস্তায়, স্কুল–কলেজে—চাঁদাবাজির গ্রাস সর্বত্র
মোহাম্মদপুরে গৃহিণীদের নিয়ম—প্রতি মাসে চাঁদা
মোহাম্মদপুরের এক গৃহিণী জানান— “বাড়িভাড়ার মতো কিশোর গ্যাংদের চাঁদা দিতে হয়। না দিলে জীবন নরক বানিয়ে দেবে।”
এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার মেয়ে হয়রানির শিকার হন শুধু চাঁদা দিতে অস্বীকার করায়। স্থানীয়রা বলেন—পুলিশকে জানালে উল্টো বিপদ বাড়ে।
পরিবহন খাত—সবচেয়ে বেশি চাঁদার রাজত্ব
পরিবহন খাতে আগে থেকেই চাঁদাবাজি ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নেতৃত্ব এসে চাঁদার হার আরও বাড়িয়েছে। ট্রাক–বাসের পথে পথে পুলিশ, শ্রমিক ইউনিয়ন, রাজনৈতিক গোষ্ঠী—সবাই হাত পেতে দাঁড়ায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বাদ নয়
কুমিল্লার একটি বেসরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। না দিলে তাঁকে ‘স্বৈরাচারের দোসর’ বলে প্রচার চালানো হয়, দুই দিনের মাথায় আন্দোলন শুরু হয়, এবং শেষে তাঁকে অপমানজনকভাবে পদত্যাগ করতে হয়। কিন্তু অভিভাবকদের মতে—তিনি কখনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
চাঁদাবাজির ভয়ংকর প্রভাব: ভেঙে পড়ছে অর্থনীতি, সমাজ হারাচ্ছে নিরাপত্তা
চাঁদাবাজি এখন শুধু ব্যবসাবাণিজ্য নয়; দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে কলাপসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ এটি, যা ভোক্তার কাঁধে অতিরিক্ত বোঝা চাপায়। একই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা এবং শিক্ষাঙ্গন পর্যন্ত দুর্নীতি–চাঁদাবাজির ছোবল থেকে মুক্ত নয়।
সাধারণ মানুষ আজ চরম অসহায়।
রাষ্ট্র, সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী—সবাই যেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। ফলে চাঁদাবাজি এখন অপ্রতিরোধ্য মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
সমাধানের একমাত্র পথ: রাষ্ট্রীয় কঠোরতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা
বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন—
-
শক্ত হাতে চাঁদাবাজদের ধরতে হবে
-
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা শূন্য সহনশীলতায় আনতে হবে
-
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি মোকাবিলা করতে হবে
-
ব্যবসায়ীদের জন্য নিরাপদ পরিবহন–সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে
সবার মতে, রাষ্ট্র কঠোর না হলে চাঁদাবাজি থামবে না, অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



