ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা আসার পরই রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক তৎপরতা বেড়েছে। নির্বাচন কমিশনও ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জোট গঠন ও আসন সমঝোতা নিয়ে ততই জটিলতা বাড়ছে। তফসিল ঘোষণার সন্নিকটে এসেও জোটের কাঠামো, আসন বণ্টন এবং প্রতীক সংকটের কারণে বড় রাজনৈতিক দলগুলো এখনো কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি। ফলে রাজনৈতিক মাঠে জোট–রাজনীতিকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে অচলাবস্থার মতো পরিস্থিতি।
চার দিক থেকে জোট গঠনের চেষ্টা—কিন্তু সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ সূত্রগুলো বলছে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অন্তত চারটি সম্ভাব্য জোট গঠনের প্রচেষ্টা চলছে। বিএনপি তাদের যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে বড় একটি জোটের লক্ষ্যে এগোচ্ছে। পাশাপাশি এনসিপি, খেলাফত মজলিসসহ আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে পৃথক আসন-সমঝোতার আলোচনা করছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে আরও একটি ইসলামী দলসমূহের জোট গঠনের প্রক্রিয়াকে। একই সময়ে এনসিপি দ্বিমুখী কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে—তারা বিএনপি বা জামায়াত দু’দলের সঙ্গেই আলোচনায় আছে, আবার স্বতন্ত্রভাবে নিজেদের নেতৃত্বে পৃথক একটি জোট গঠনের তৎপরতাও চালিয়ে যাচ্ছে।
বামপন্থী দলগুলোও পিছিয়ে নেই। সিপিবির নেতৃত্বে বাম গণতান্ত্রিক জোট, আদিবাসী সংগঠনগুলো, দলিত সংগঠন এবং বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন নিয়ে বৃহৎ বাম রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের চেষ্টা চলছে।
বিএনপি—২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা, কিন্তু জোটের জট রয়ে গেছে
৩ নভেম্বর বিএনপি ২৩৭ আসনে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করে দেশব্যাপী প্রচারের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছে। প্রার্থী ঘোষণার পর বিএনপি মাঠে নেমে পড়লেও জোটের শরিক দলেরা একই আসনে প্রচারণা চালাতে গিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ছে। ফলে বিএনপি–ব্যতীত জোটের অন্যান্য দল এখনো নিশ্চিত নয় কোন আসনে তাদের প্রার্থী দেওয়া হবে।
আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং নজরুল ইসলাম খানকে। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, বিএনপি মোট ৬৪টি আসন ‘ফাঁকা’ রেখে শরিকদের ২০–২২টি আসন ছাড়তে পারে। তবে এনসিপি ও খেলাফত মজলিসের সঙ্গে সমঝোতা হলে ছাড়ের সংখ্যা ৪০-এর কাছাকাছি যেতে পারে।
কিছু শরিক দলের শীর্ষ নেতাকে প্রার্থী করা না গেলে ভবিষ্যৎ সরকারের সুবিধাজনক পদ দেওয়ার আশ্বাস—এ ধরনের রাজনৈতিক সমীকরণও আলোচনায় রয়েছে।
জামায়াত—৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা, ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে বড় জোটের উদ্যোগ
ইতোমধ্যে ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। আটটি সমমনা ইসলামী দলের সঙ্গে আন্দোলনে মাঠে থাকা জামায়াত নির্বাচনেও যৌথভাবে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি আরও কয়েকটি ইসলামী দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা এহসানুল মাহবুব জুবায়ের জানিয়েছেন, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ বা তফসিল ঘোষণার সময়ের মধ্যেই আসন–সমঝোতা চূড়ান্ত হতে পারে।
এনসিপি—সবচেয়ে কৌশলী অবস্থান, বিএনপি-জামায়াত কারও সঙ্গে নয়তো স্বাধীন জোট
এনসিপি একাধারে বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, আবার নিজেরাই ‘সংস্কার জোট’ গঠনের প্রস্তুতিও রাখছে। এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে আলোচনা তাদের চলমান।
সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী স্পষ্ট করে বলেছেন—
-
বিএনপি বা জামায়াত যদি রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে লিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে জোটে যেতে পারে
-
শর্ত পূরণ না হলে তারা স্বতন্ত্র ‘সংস্কার জোট’ গঠন করবে
বামপন্থী ফ্রন্ট—সিপিবির নেতৃত্বে একটি বৃহৎ বাম ঐক্যের প্রচেষ্টা
সিপিবি সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব বাম সংগঠনকে নিয়ে একটি বৃহত্তর জোট গঠনের চেষ্টা চলছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের ছয়টি দল ছাড়াও সংযুক্ত হবে—
-
আদিবাসী সংগঠন
-
দলিত সংগঠন
-
নাগরিক প্ল্যাটফর্ম
তারা ২৫ নভেম্বর নিজেদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করবে।
‘নিজস্ব প্রতীক’—সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম
বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা বলছেন, এবার নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীক ব্যবহার বাধ্যতামূলক হওয়ায় ছোট দলগুলোর বড় সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। অনেক দলই জনপ্রিয় প্রতীক না থাকায় ভোটারদের কাছে নিজেদের পরিচিত করাতে পারছে না। ফলে জোট থেকে আসন পেলেও নির্বাচনী মাঠে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন,
“অনেক দলের প্রতীক মানুষ চেনে না। তাই প্রতীক পরিবর্তন বা পরিচিত প্রতীক ব্যবহারের অনুমতির জন্য আমরা নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছি।”
শেষ মুহূর্তের দর-কষাকষিতে রাজনৈতিক উত্তেজনা তুঙ্গে
সব মিলিয়ে—
-
বিএনপি তাদের ‘বড় জোট’ চূড়ান্ত করতে পারেনি
-
জামায়াত তাদের সমমনা দলগুলো নিয়ে জোট জটিলতার মধ্যে
-
এনসিপি দুই দিকে ঝুঁকে কৌশলী অবস্থান ধরে রেখেছে
-
বাম দলগুলোও নিজেদের বৃহৎ ফ্রন্ট গঠনের প্রচেষ্টায় ব্যস্ত
তফসিল ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ বাকি থাকতে রাজনৈতিক অঙ্গন এখন ‘জোট–রাজনীতির অচলাবস্থায়’ আটকে আছে।
সকল দলের মূল সমস্যা—
কাকে কত আসন ছাড়বে
কার প্রতীকে সাধারণ ভোটার ভোট দেবে
এবং ভবিষ্যৎ সরকারে শীর্ষ ভূমিকা কারা পাবে
এই তিন মাধ্যমে গোলকধাঁধার মতো জটিলতা তৈরি হয়েছে।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, জোট–সমীকরণের জটিলতা ততই বাড়ছে—এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



