ছবি: সংগৃহীত
কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিএন্ডএফ) এজেন্ট এবং আমদানি–রপ্তানিকারক মোহাম্মদ শাহজাহান ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা আক্তারের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পৃথক দুটি মামলা করেছে। একদিকে দীর্ঘদিন ধরে আমদানি–রপ্তানি খাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত থাকা শাহজাহান, অন্যদিকে গৃহিণী পরিচয়ের আড়ালে কোটি টাকার সম্পদ অর্জনকারী ফারজানার বিরুদ্ধে এই মামলা দুদকের সাম্প্রতিক অনুসন্ধান কার্যক্রমে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুদকের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাগুলো দায়ের করেন।
এজাহার অনুযায়ী, মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২ কোটি ৮৩ হাজার ৭৩৪ টাকার সম্পদের অসামঞ্জস্য পাওয়া গেছে। দুদক বলছে, তদন্তে দেখা যায়, তাঁর ঘোষিত আয়, পরিচিত উৎস এবং ব্যবসায়িক লেনদেন বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে তাঁর হাতে থাকা সম্পদের পরিমাণ কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
অনুসন্ধান দলের পক্ষ থেকে বলা হয়, শাহজাহান যে পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন, তার উৎস হিসেবে তিনি যে নথিপত্র দিয়েছেন তা পর্যাপ্ত নয় এবং বেশ কয়েকটি জায়গায় সুনির্দিষ্ট ব্যয়ের হিসাব এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এমনকি তিনি নিজ ভোগ–দখলে রেখেছেন এমন বিভিন্ন সম্পদ সম্পর্কেও সঠিক তথ্য প্রদান করেননি। এসব বিবেচনায় দুদক আইনের ২৭(১) ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হয়েছে।
শুধু শাহজাহানই নন, তাঁর স্ত্রী ফারজানা আক্তারের বিরুদ্ধেও গুরুতর অসঙ্গতির সন্ধান পেয়েছে দুদক। সম্পদ বিবরণীতে গোপন এবং জ্ঞাত আয়ের বাইরে সম্পদ অর্জনের অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁর নামে আরেকটি মামলা করা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী, ফারজানার নামে মোট ১৩ কোটি ৪৭ লাখ ৯৬ হাজার ৬৮ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গ্রহণযোগ্য আয় ও ব্যয় যাচাই–বাছাই করে দুদক নিশ্চিত হয়েছে যে প্রায় ১১ কোটি ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ২০০ টাকার সম্পদের বৈধ উৎস রয়েছে। কিন্তু বাকিটা—দুই কোটি ৩২ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৮ টাকা—তিনি কীভাবে অর্জন করেছেন তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সম্পদ বিবরণীতে তিনি ৫১ লাখ ৯৩ হাজার ৩৪৮ টাকার সম্পদ গোপন করেছেন, যা দুদক আইনের চোখে গুরুতর অপরাধ।
এসব কারণে তাঁর বিরুদ্ধে দুদক আইন, ২০০৪–এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারায় মামলা হয়েছে। এই ধারাগুলোর আওতায় সম্পদ গোপন করার পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের মতো অপরাধের শাস্তি প্রমাণিত হলে হতে পারে কঠোর।
দুদক সূত্র জানায়, শাহজাহান ও ফারজানার ব্যাংক হিসাব, জমি–বাড়ি, যানবাহন, বিনিয়োগ, ব্যবসায়িক লেনদেনসহ গত কয়েক বছরের আর্থিক নথিপত্র খতিয়ে দেখা হয়। বিশেষভাবে নজরে আসে দম্পতির জীবনযাত্রার ব্যয় এবং আয়–ব্যয়ের মধ্যে অসংগতির বিষয়টি।
দুদকের তদন্ত দল শনাক্ত করে যে ব্যবসার আয় তুলনামূলক কম হলেও তাঁদের সম্পদ বাড়ার হার অত্যন্ত দ্রুত। একাধিক ব্যাংক হিসাব ও আলাদা নামে সম্পত্তি কেনাবেচার তথ্য পাওয়ায় সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। তদন্তে উঠে আসে এমন কিছু বিনিয়োগ ও জমির মালিকানা, যা দম্পতির আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
মামলাগুলো দায়ের হওয়ার পর শিগগিরই তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে। তাঁরা সাক্ষ্য–প্রমাণ সংগ্রহ, ব্যাংক হিসাব জব্দের আবেদন, সম্পদের উৎস যাচাইসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। দোষ প্রমাণিত হলে এই মামলাগুলোতে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ড এবং সম্পদ বাজেয়াপ্তের আদেশ দেওয়া হতে পারে।
দুদক জানায়, গত কয়েক মাস ধরে সিএন্ডএফ খাত, আমদানি–রপ্তানি ব্যবসা এবং কর–কাস্টমস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাড়তে থাকায় সংস্থাটি বিশেষ নজরদারি চালাচ্ছে। শাহজাহান দম্পতির মামলাও সেই নজরদারির অংশ হিসেবে এসেছে।
মামলার খবর প্রকাশের পর ব্যবসায়িক মহলে বিস্তর আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, দীর্ঘদিন ধরে অস্বচ্ছ লেনদেন, অবৈধ কমিশন, চালান জালিয়াতি এবং আমদানি–রপ্তানির আড়ালে অবৈধ অর্থপ্রবাহ নানা মাধ্যমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফলে দুদকের এমন পদক্ষেপ খাতটিকে শুদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অন্যদিকে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, শুধু দু-একজন ব্যবসায়ীকে ধরলে হবে না; বরং পুরো শৃঙ্খল ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরগুলোর ভেতরের অনিয়ম, যোগসাজশ ও দুর্নীতি শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
শাহজাহান ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা আক্তারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের মামলা আমদানি–রপ্তানি খাতে আর্থিক অসঙ্গতি ও অনিয়মের একটি বড় চিত্র সামনে এনেছে। দুদকের অনুসন্ধান অনুযায়ী তাঁদের সম্পদ বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত উৎস, যা এখন আইনের বিচারে প্রমাণিত হওয়ার অপেক্ষায়। মামলা দুটি খাতটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



