ছবি: সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) কার্যনির্বাহী সদস্য উম্মে উসওয়াতুন রাফিয়াকে ঘিরে সাম্প্রতিক বিতর্ক সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার দিন ধানমণ্ডিতে পুলিশের সঙ্গে তাঁর তীব্র বাকবিতণ্ডার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক মাধ্যমে। বিশেষ করে ফেসবুক ও এক্স–এ নানাজনের মন্তব্য রাফিয়াকে কেন্দ্র করে আরও উত্তপ্ত করেছে বিতর্কের পরিবেশ। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ও আলোচিত শিক্ষিকা শেহরীন আমিন ভূঁইয়া মোনামি।
মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) রাতে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশিত একটি দীর্ঘ পোস্টে তিনি স্পষ্ট ভাষায় রাফিয়ার প্রতি সমর্থন জানান এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে ঘিরে চলা একপেশে বিচার ও নেতিবাচক প্রচারকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে আখ্যায়িত করেন। মোনামির পোস্ট প্রকাশের পর নতুন করে বিতর্কের স্রোত বইতে শুরু করেছে, তবে অনেকেই তাঁর যুক্তিকে সাহসী ও সময়োচিত বলে অভিহিত করছেন।
রায় ঘোষণার দিন ধানমণ্ডির নিরাপত্তা পরিস্থিতি ছিল উত্তেজনাপূর্ণ। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, স্লোগান, পুলিশের সতর্ক অবস্থান—সব মিলিয়ে রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল সময়। এসময় পুলিশের সঙ্গে রাফিয়ার মুখোমুখি তীব্র বাকবিতণ্ডার একটি ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন পুলিশ সদস্য রাফিয়াকে দমিয়ে রাখতে একের পর এক নির্দেশ দিচ্ছেন; অন্যদিকে রাফিয়া দৃঢ় ভাষায় নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করছেন, প্রতিবাদ করছেন এবং পুলিশের আচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন।
ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তাকে অনেকেই ‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী’, ‘উসকানিদাতা’ বা ‘অহংকারী’ বলে আখ্যায়িত করেন। বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়, তাঁর হিজাব পরা পরিচয়কে কেন্দ্র করে অনেকে ব্যক্তিগত আক্রমণেও জড়ান। যার ফলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু থেকে ঘটনাটি সরে গিয়ে তা পরিণত হয় রাফিয়ার বিশ্বাস, পোশাক এবং ব্যক্তিগত পরিচয়কে কেন্দ্র করে বিস্তৃত সমালোচনায়।
মোনামি তাঁর পোস্টে লিখেছেন, “তাকে এভাবে টার্গেট করা হচ্ছে মূলত কারণ সে নিজের ধর্মীয় পরিচয়কে দৃশ্যমানভাবে ধারণ করে। একই assertiveness, protest বা ভাষা যদি কোনো নন–হিজাবি মেয়ের কাছ থেকে দেখা যেত, তবে আজকের তথাকথিত ‘সুশীল’ মহল সেটিকে সাহসী অবস্থান বলে বাহবা দিত।”
মোনামির এই মন্তব্য দ্রুত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে। তিনি স্পষ্ট করে জানান, বাংলাদেশের সমাজে নারীর ক্ষমতায়নকে দেখার একটি প্রচলিত ও পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যেখানে হিজাব পরা নারীর প্রতিবাদ বা দৃঢ় অবস্থানকে সহজে ইতিবাচকভাবে দেখা হয় না।
তিনি আরও বলেন, একই কর্ম, একই কণ্ঠস্বর ও একই ভাষা হিজাব পরিহিত নারীর ক্ষেত্রে ‘বিদ্রোহী’ বা ‘অশান্ত’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, অথচ পাশ্চাত্য অনুকরণীয় পোশাকধারী নারীর ক্ষেত্রে তা ‘ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত’ হিসেবে প্রশংসিত হয়। তাঁর মতে, এই দ্বৈত মানদণ্ড নারী আন্দোলনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যায়।
মোনামি শুধু রাফিয়াকে ঘিরে গড়ে ওঠা সমালোচনাকে নয়, ঘটনার সময় পুলিশের আচরণকেও কঠোরভাবে সমালোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “উত্তপ্ত মুহূর্তে পুলিশের আচরণ ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য, অসম্মানজনক এবং নির্যাতনমূলক।”
তিনি উল্লেখ করেন, উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালনে পুলিশের আরও সতর্ক, সংযত ও মানবিক আচরণ প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু ভিডিওতে দেখা যায়, রাফিয়াকে লক্ষ্য করে পুলিশের ধমক, কঠোর নির্দেশ এবং চাপ প্রয়োগের ভাষা ছিল স্পষ্টভাবে অসম্মানজনক।
তাঁর মতে, একজন নারী, বিশেষত একজন শিক্ষার্থী-নেত্রীর সঙ্গে এমন আচরণ একদিকে আইনের সীমা অতিক্রম করে, অন্যদিকে নারীর প্রতি আচরণে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্মোচন করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে—এই আচরণকে অধিকাংশ মানুষ ‘অত্যাচার’ হিসেবে দেখছেন না; বরং রাফিয়ার ভাষা ও প্রতিক্রিয়াকেই ভুল প্রমাণ করতে ব্যস্ত।
মোনামির পোস্টের সবচেয়ে আলোচিত অংশ ছিল নারীবাদী অভিব্যক্তি নিয়ে তাঁর মন্তব্য। তিনি বলেন, “রাফিয়ার প্রতিক্রিয়া নারীর ক্ষমতায়ন হিসেবে দেখা হচ্ছে না, কারণ তার ফেমিনিস্ট এক্সপ্রেশন বাংলাদেশে স্বীকৃত সেই সংকীর্ণ ও চয়েস-ভিত্তিক feminism এর সঙ্গে মেলে না।”
তার মতে, বাংলাদেশের মূলধারার নারীবাদ এখনও পোশাক, বাহ্যিক স্বাধীনতা এবং পশ্চিমা ধাঁচের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে সীমাবদ্ধ। ফলে একজন ধর্মীয় পরিচয় লুকিয়ে না রেখে, হিজাব পরে, দৃঢ় কণ্ঠে, পুলিশের মুখোমুখি দাঁড়ানো নারীকে ‘ক্ষমতায়নের প্রতীক’ হিসেবে দেখার মানসিকতা গড়ে ওঠেনি।
মোনামি মনে করেন, নারীর ক্ষমতায়ন শুধু পোশাকে নয়; বরং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের বক্তব্য বলার সাহস, অন্যায়কে অস্বীকার করার দৃঢ়তা এবং নিজের পরিচয় নিয়ে আত্মবিশ্বাস—এসবই ক্ষমতায়নের প্রকৃত মাপকাঠি। রাফিয়ার আচরণে তিনি সেসব বৈশিষ্ট্য দেখেছেন বলেই প্রকাশ্যে তাঁর পক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
মোনামির পোস্ট প্রকাশের পর সামাজিকমাধ্যমে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
-
একদল বলছে, তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তুলেছেন—হিজাবধারী নারীদের প্রতি সমাজের পক্ষপাত ও ডাবল স্ট্যান্ডার্ড এখন প্রকাশ্য আলাপের বিষয় হওয়া উচিত।
-
অন্যদল বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী প্রক্টর হিসেবে তাঁর এমন প্রকাশ্য রাজনৈতিক মন্তব্য বিভাজন তৈরি করতে পারে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে আরও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে।
তবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকদের মতে, এই বিতর্ক বাংলাদেশের নারী আন্দোলন, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতি সহনশীলতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ—সবকিছুকে নতুনভাবে আলোচনায় এনেছে।
রাফিয়াকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে সমালোচনার ঝড় বইছে, তার মধ্যে মোনামির সমর্থন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি শুধু রাফিয়ার পাশে দাঁড়াননি; বরং সমাজের প্রচলিত নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় পরিচয়ধারী নারীর প্রতি বিরূপ সামাজিক আচরণ এবং পুলিশের অগ্রহণযোগ্য আচরণ—সবকিছু নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন জোরালোভাবে।
এতে করে বিতর্ক সাময়িকভাবে আরও তীব্র হলেও, বৃহত্তর পরিসরে এটি নারীর অবস্থান, প্রতিরোধের ভাষা এবং সামাজিক মূল্যবোধ নিয়ে নতুন আলোচনা তৈরি করেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



