
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশকে তার রাজস্ব ও আর্থিক খাতের কাঠামোগত সংস্কার প্রক্রিয়া আরও জোরদারভাবে এগিয়ে নিতে হবে—এমন পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভাগের পরিচালক কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন বলেছেন, বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য রাজস্ব আয়ের ভিত্তি সম্প্রসারণ এবং আর্থিক খাতের দুর্বলতা দূর করা এখন সময়ের দাবি।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশকে অবশ্যই সংস্কারের প্রধান ক্ষেত্রগুলোতে ধারাবাহিকভাবে কাজ চালিয়ে যেতে হবে—বিশেষ করে রাজস্ব খাতে, যেখানে আয় বৃদ্ধি সংস্কার প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো আর্থিক খাত। এই দুই খাতেই গভীর সংস্কার প্রয়োজন, যা আমাদের আসন্ন পর্যালোচনার মূল ফোকাস হবে।”
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনের এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন। তিনি জানান, আইএমএফের পরবর্তী পর্যালোচনামূলক দল খুব শিগগিরই বাংলাদেশ সফরে আসবে, যেখানে তারা রাজস্ব প্রশাসন, মুদ্রানীতি ও আর্থিক খাতের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবে।
আইএমএফ সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৫ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ করেছে। এ প্রসঙ্গে কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন বলেন, “আমাদের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সাম্প্রতিক সময়ে তিনটি মূল কারণে মন্থর হয়েছে। প্রথমত, নীতিগত মিশ্রণ কিছুটা কঠোর হয়েছে—বিশেষ করে মুদ্রানীতি ও আর্থিক নীতি দুই দিকেই। দ্বিতীয়ত, শুল্কনীতি ও রাজস্ব কাঠামোয় অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থায় প্রভাব ফেলেছে। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রভাব ফেলছে সামষ্টিক অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে নির্বাচনের আগে ব্যবসায়িক পরিবেশে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে তা।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের মতে, শুল্কনীতি সংক্রান্ত অনিশ্চয়তার বাইরেও দুটি বড় বিষয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করছে—প্রথমটি আসন্ন জাতীয় নির্বাচন, যা স্বাভাবিকভাবেই বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলছে। দ্বিতীয়টি হলো, আর্থিক খাতের গভীর দুর্বলতা, যা ঋণপ্রবাহ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।”
আইএমএফ পরিচালক বলেন, “আমরা মনে করছি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শেষে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এটি মূলত সরবরাহপক্ষীয় ধাক্কার ফলাফল—বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং আমদানি ব্যয়ের চাপ থেকে সৃষ্টি হয়েছে।”
তিনি পরামর্শ দেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে (বাংলাদেশ ব্যাংক) অবশ্যই মুদ্রানীতিকে আরও কঠোর ও লক্ষ্যভিত্তিক করতে হবে, যাতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং টাকার মান স্থিতিশীল থাকে। “অত্যধিক মুদ্রা সরবরাহ এবং অপ্রয়োজনীয় আমদানি চাহিদা নিয়ন্ত্রণে না আনলে মূল্যস্ফীতি আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে,” বলেন তিনি।
কৃষ্ণা শ্রীনিবাসনের মতে, বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত এখনো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। সরকারি রাজস্ব আয় জিডিপির মাত্র ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, যা উন্নয়ন ব্যয় ও সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, “টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশকে তার কর কাঠামো আধুনিকায়ন করতে হবে। কর প্রশাসনের ডিজিটালাইজেশন, কর ফাঁকি রোধ, ভ্যাট নেট সম্প্রসারণ, এবং আমদানি নির্ভর রাজস্ব থেকে অভ্যন্তরীণ উৎসভিত্তিক আয়ে রূপান্তর—এসব সংস্কার এখন অপরিহার্য।”
আইএমএফের পরিচালক আরও জানান, “বাংলাদেশে এখনও করদাতাদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। টিআইএনধারী অনেকেই নিয়মিত রিটার্ন দেন না। সুতরাং কর প্রশাসনের সক্ষমতা বাড়ানো এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ছাড়া রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব নয়।”
আইএমএফ মনে করছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাত দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনা, খেলাপি ঋণ, এবং প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে জর্জরিত। কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন বলেন, “ব্যাংক খাতে দুর্বল শাসনব্যবস্থা, অস্বচ্ছ ঋণ বিতরণ, এবং উচ্চ খেলাপি ঋণের কারণে ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে।”
তিনি উল্লেখ করেন, আইএমএফের আসন্ন মিশন এই খাতের কাঠামোগত দুর্বলতা নিরসনে করণীয় বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে। “আমরা চাই ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ত হোক, অনাদায়ী ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নত হোক, এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বাধীনতা আরও বৃদ্ধি পাক,” বলেন তিনি।
কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন বলেন, “বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে নীতিগত ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, যা বিনিয়োগ ও ব্যবসার সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলছে। তবে এটি সাময়িক—যদি নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়, তাহলে অর্থনীতি দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে পারবে।”
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের পর যেকোনো সরকারকেই অবশ্যই অর্থনৈতিক সংস্কারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। “যদি সংস্কার থেমে যায়, তাহলে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হবে, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ঝুঁকি সূচক বাড়বে,” তিনি সতর্ক করেন।
সংবাদ সম্মেলনে কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন আরও জানান, খুব শিগগিরই আইএমএফের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করবে। সফরকালে তারা ঋণ কর্মসূচির তৃতীয় পর্যালোচনা সম্পন্ন করবে এবং চলমান সংস্কারের অগ্রগতি মূল্যায়ন করবে।
“আমাদের লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীলতার পথে রাখতে সাহায্য করা। তবে সেই পথে হাঁটতে হলে কঠিন সংস্কার সিদ্ধান্ত নিতে হবে—বিশেষ করে কর রাজস্ব বৃদ্ধি ও ব্যাংক খাতের সংস্কার,” বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফের কাছ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন পায়। এর অংশ হিসেবে দেশটি ইতোমধ্যে দুটি কিস্তি পেয়েছে। তবে তৃতীয় কিস্তি পেতে হলে রাজস্ব ও আর্থিক খাতের সংস্কারে দৃশ্যমান অগ্রগতি প্রদর্শন করতে হবে।
আইএমএফের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক ধরনের রূপান্তরপর্বে রয়েছে—যেখানে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের পথে টেকসই রাজস্বনীতি ও শক্তিশালী আর্থিক কাঠামোই হতে পারে সফলতার ভিত্তি।
আইএমএফের এই পরামর্শ বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। রাজস্ব খাতের সংস্কার, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা, এবং নীতিগত স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে সামনের বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধি আরও ধীর হতে পারে।
যেমনটি কৃষ্ণা শ্রীনিবাসন স্পষ্টভাবে বলেছেন— “বাংলাদেশকে শুধু ঋণের ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করতে হবে—তবেই টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।”
বাংলাবার্তা/এসজে