ছবি: সংগৃহীত
একসময় যিনি পরিচিত ছিলেন তরুণ ক্রিকেটার তৈরির নিবেদিত এক কোচ হিসেবে, যিনি নিজেকে বলতেন ‘ক্রিকেট সংস্কারক’— সেই সাইফুল ইসলাম খোকন আজ অনেকের কাছে একাডেমিক ক্রিকেটে ভয়, প্রতারণা ও দখলদারির প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তার চলাফেরা, আচরণ, সিদ্ধান্ত— সবকিছুর মধ্যেই যেন ফুটে উঠেছে এক অদৃশ্য মাফিয়া শাসনের ছাপ। মেয়ে কেলেঙ্কারি, খেলোয়াড়দের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়া, জোরজবরদস্তি করে একাডেমির ওপর নিয়ন্ত্রণ— প্রতিটি অভিযোগই যেন আরও বড় করে দেখায় এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা: সাইফুল ইসলামের হাতে বি.জি. প্রেস একাডেমি আজ ‘স্বপ্ন গড়ার কারখানা’ নয়; বরং অন্ধকারে ডুবে যাওয়া একটি কারখানা, যেখানে প্রতিভা হারিয়ে যাচ্ছে ভয়, অপমান আর দুর্নীতির ধোঁয়ায়।
খেলাঘর থেকে পতন: কেলেঙ্কারির সূচনা
সময়টা ২০২০ সাল। খেলাঘর ক্রিকেট দলের সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করছিলেন সাইফুল ইসলাম খোকন। প্রথমদিকে তাকে দেখা হতো দক্ষ, শৃঙ্খলাপরায়ণ, ক্রিকেটকে ভালোবাসেন এমন এক প্রশিক্ষক হিসেবে। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, তার অন্ধকার দিকগুলো প্রকাশ হতে শুরু করে।
দলের ভেতর থেকে একের পর এক অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে— নারীঘটিত সম্পর্ক, নারী সহকর্মী ও দর্শকদের হয়রানি, অশোভন মন্তব্য, খেলোয়াড়দের প্রতি অনৈতিক আচরণ এবং ব্যক্তিগত জীবনে পরকীয়ার।
এক পর্যায়ে অভিযোগ এতটাই গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছে যে ক্লাব কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। তাকে সরাসরি দল থেকে বরখাস্ত করা হয়। একই সময়ে পরকীয়ার জেরে ভাঙে তার সংসার। খেলার মাঠ থেকে, পরিবার থেকে, সমাজ থেকে— প্রতিটি জায়গা যেন তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়।
দুই মাস বেকার জীবন কাটানোর পর তার পাশে দাঁড়ান ইফাত মাহমুদ শরীফ ও মনিরুজ্জামান পলাশ। তাদের হাত ধরেই শুরু হয় নতুন অধ্যায়— ‘বি.জি. প্রেস ক্রিকেট একাডেমি’র।
একাডেমি প্রতিষ্ঠার পর ইফাত মাহমুদ শরীফের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ জন তরুণ খেলোয়াড় ভর্তি হন। সাইফুল ইসলাম শুরুতেই বড় বড় স্বপ্ন দেখান— এই একাডেমি হবে জাতীয় দলের নতুন প্রতিভার জন্মস্থান, যারা মেহনত করবে, তারাই সুযোগ পাবে, এখান থেকে দেশের সেরা খেলোয়াড় তৈরি হবে ইত্যাদি।
কিন্তু স্বপ্নগুলো ভেঙে যেতে বেশি সময় লাগেনি। মাত্র ছয় মাসের মধ্যে বাস্তবতা একেবারে পাল্টে যায়। শুরু হয় অনিয়ম, পক্ষপাত ও দুর্নীতির ভয়ঙ্কর এক চক্র।
একাডেমির খেলোয়াড়রা জানাচ্ছেন— পারফরম্যান্স দেখেই দল গঠন হয়নি, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও পছন্দ-অপছন্দই ছিল মূল মানদণ্ড, বাইরের খেলোয়াড় আনতে নেওয়া হয়েছে নির্দিষ্ট অংকের টাকা এবং টাকা দিলে দেশে-বিদেশে খেলার সুযোগের লোভ দেখানো হয়েছে।
ফলে একাডেমির স্থায়ী শিক্ষার্থীদের জায়গা দখল করে নেয় বাইরের অযোগ্য খেলোয়াড়রা। যারা দীর্ঘদিন কঠোর প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন, তারা মুহূর্তেই হয়ে যান অবাঞ্ছিত।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রায় ৪০ জন শিক্ষার্থীকে কয়েক মাসের মধ্যেই একাডেমি থেকে বের করে দেওয়া হয়। অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে ক্রিকেট ছেড়ে দেন। আবার কেউ কেউ ন্যায়বিচারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ালেও ফল হয়নি।
শুধু দুর্নীতি নয়, সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে আরও ভয়াবহ অভিযোগ।
খেলোয়াড়দের বর্ণনায়— তিনি নিয়মিত গালিগালাজ করতেন, কখনও শারীরিকভাবে আঘাত করতেন, মানসিকভাবে ভেঙে ফেলতেন, অপমানজনক ভাষায় কথা বলতেন, “তুমি কিছুই না” এমন কথায় তরুণদের আত্মবিশ্বাস চূর্ণ করতেন।
কিছু খেলোয়াড় এমনকি জানিয়েছেন— তিনি নিজের ক্ষমতার ভয় দেখিয়ে সবাইকে দমিয়ে রাখতেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে দল থেকে বাদ দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির হুমকিও দিতেন।
ঢাকালিগে খেলার সুযোগ দেওয়ার নাম করে অনেক খেলোয়াড়ের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে মোটা অংকের টাকা। কেউ দিয়েছে ৫০ হাজার, কেউ দিয়েছে এক লাখ, কেউ আবার আরও বেশি।
কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি কখনই পূরণ করেননি। অর্থ নেওয়ার পর তিনি দায়িত্ব এড়িয়ে যান এবং খেলোয়াড়দের ওপর নানা সময় চাপ সৃষ্টি করেন মুখ বন্ধ রাখার জন্য।
অনেকেই বলেন— “টাকা না দিলে মাঠে জায়গা নেই। সাইফুল স্যার বলতেন, টাকা দিলে সব ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু পরে আর ফোনও ধরতেন না।”
যে একাডেমিটি গড়ে উঠেছিল তরুণদের স্বপ্ন পূরণের জন্য, সেটিকেই ধীরে ধীরে নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো ব্যবহার করতে শুরু করেন সাইফুল ইসলাম।
প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মতামত উপেক্ষা
আর্থিক লেনদেন নিজের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া
কোচিং স্টাফ পরিবর্তন
খেলোয়াড়দের ওপর একচ্ছত্র দাপট
ভিতরে নিজের লোকজন বসিয়ে ‘মাফিয়ার ঘাঁটি’ তৈরি
ধীরে ধীরে একাডেমির প্রকৃত মালিকানা এবং পরিচালনা-ব্যবস্থাপনাও চলে যায় তার হাতেই।
ফলে একসময় যাদের হাত ধরে একাডেমি শুরু হয়েছিল, তারাই আজ একাডেমির ভেতরে ঢুকতেই ভয় পান।
বাংলাদেশ ক্রিকেটে সম্ভাবনা আজও বিপুল। কিন্তু সাইফুল ইসলামের মতো কিছু ব্যক্তির কারণে অনেক প্রতিভা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন খেলোয়াড়, অভিভাবক ও সাবেক কোচরা।
যদি এ ধরনের আচরণ, দুর্নীতি, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ না হয় তাহলে আরও অনেক তরুণ খেলোয়াড় অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।
খেলোয়াড়, অভিভাবক, স্থানীয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব— সবার একই দাবি— বি.জি. প্রেস ক্রিকেট একাডেমিতে কী হচ্ছে, তার সঠিক তদন্ত হোক। সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। প্রতিভাবান তরুণদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা হোক।
কারণ একটি একাডেমি শুধু খেলোয়াড় তৈরি করে না— এটি তৈরি করে আত্মবিশ্বাস, স্বপ্ন, শৃঙ্খলা। আর সেই জায়গাটিকে যদি কেউ ভয় আর দুর্নীতির কারখানায় পরিণত করে, তবে সেটি জাতীয় ক্ষতির শামিল।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



