ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির তদন্ত প্রায় শেষের দিকে। এ তদন্ত পরিচালনা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। খসড়া প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আগুনে প্রায় ৮৫০ কোটি টাকার সমমূল্যের ১২শ টন পণ্য পুড়ে নষ্ট হয়েছে। পণ্যের ধরন এত বেশি ছিল যে তালিকা তৈরিতেই তদন্ত কমিটিকে হিমশিম খেতে হয়েছে। সেখানে ওষুধ, কসমেটিকস, ইলেকট্রনিক্স, মোবাইল ফোন, বিভিন্ন শিল্পকারখানার কাঁচামাল, তৈরি পোশাক শিল্পের অ্যাক্সেসরি, খাদ্যপণ্য, যন্ত্রাংশ, গাড়ির পার্টসসহ হাজারো ধরনের পণ্য মজুত ছিল। এ ছাড়া বহু চালানপত্র ও নথি আগুনে পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতিপূরণের হিসাব নির্ধারণ এবং মালিকানা নিশ্চিত করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। খসড়া প্রতিবেদনে ভবিষ্যতের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
তদন্ত কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, আমদানি করা পণ্য ২১ দিনের মধ্যে খালাস করার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে অনেক পণ্য মাসের পর মাস গুদামেই পড়ে ছিল। অগ্নিকাণ্ডের তিন মাস আগের পণ্য পর্যন্ত তালিকায় পাওয়া গেছে। তদন্তে অদক্ষতা, অনিয়ম, সংস্থাগুলোর মাঝে সমন্বয়ের অভাব, জটিল কাগজপত্র, আমদানিকারকদের শিথিলতা এবং কখনও ইচ্ছাকৃত বিলম্বের মতো বিষয় উঠে এসেছে। বিমানবন্দরের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থার অফিস আলাদা জায়গায় থাকায় তথ্য বিনিময় এবং জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়ে। এক সংস্থা অন্যের ওপর দায় চাপায়, ফলে কোনো পক্ষই প্রকৃত সমস্যা স্বীকার করে না। এই বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার কারণেই ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে গেছে।
তদন্তে দেখা গেছে, আগুন লাগার পর তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা পেতে দেরি হয়েছে এবং অনেকেই দ্রুত সাড়া দেয়নি। কমিটির মতে, বিশেষ করে বাংলাদেশ বিমানের পক্ষ থেকে প্রত্যাশিত সহায়তা না পাওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। জরুরি মুহূর্তে কোন সংস্থা কীভাবে সমন্বয় করবে এবং কার দায়িত্ব কী—এসবের কোনো স্পষ্ট কাঠামো বা কার্যকর প্রটোকল বিমানবন্দরে ছিল না। দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এমন দায়িত্বহীনতা ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তদন্ত কমিটিকে বিস্মিত করেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, তাদের অনেক মালামালের চালানপত্র, নথি এবং রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নথির বড় অংশ পুড়ে গেছে, আর কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এলোমেলোভাবে মিলছে। তারা বলছেন, নথিপত্র ছাড়া ক্ষতির হিসাব দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না এবং কর্তৃপক্ষও মালিকানা নিশ্চিত করতে পারছে না। ফলে পুরো প্রক্রিয়া গভীর অনিশ্চয়তায় পড়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, খালাসের আগেই তাদের সব পণ্য পুড়ে গেছে। তাদের ব্যবসার মূল কাঁচামাল ছিল এসব পণ্য, যা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
প্রতিবেদন খসড়ায় ভবিষ্যতের জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ রাখা হয়েছে। বিমানবন্দরে কর্মরত সব সংস্থার অফিস একটি সমন্বিত কমপ্লেক্সে আনা, যাতে জরুরি পরিস্থিতিতে সবাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং দায় এড়াতে না পারে এমন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। পণ্য ২১ দিনের মধ্যে খালাস নিশ্চিত করতে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং সময়সীমা না মানলে আমদানিকারকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি শুল্ক, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, বিমান, নিরাপত্তা সংস্থা, ফায়ার সার্ভিসসহ সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি স্থায়ী সমন্বয় কমিটি গঠনেরও সুপারিশ রয়েছে।
তদন্ত কমিটির একজন কর্মকর্তা বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের ধরন এত বেশি যে সেগুলোর সঠিক মূল্য নির্ধারণেও দীর্ঘ সময় লাগবে। কোথায় কোন পণ্য ছিল, কোন বাক্সে কী ছিল, কোন চালান কোন রুমে রাখা ছিল এসবের কোনো সঠিক ডিজিটাল রেকর্ড ছিল না। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রতিটি পণ্যের পৃথক শনাক্ত নম্বর, ডিজিটাল লগ, রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছে তদন্ত কমিটি।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তদন্ত কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, চলতি সপ্তাহে প্রতিবেদন দাখিল করার কথা থাকলেও তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। আশা করছি, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকৃত তথ্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে। তারা আমাদের চাহিদা অনুযায়ী সব তথ্য দিতে পারছে না। আমরা সেভাবে সহযোগিতাও পাচ্ছি না। প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনই প্রকাশ করা ঠিক হবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



