ছবি: সংগৃহীত
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি ইসলামী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল নতুন করে পাঁচ দফা দাবি পেশ করেছে এবং সেই দাবিগুলো অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছে। দলগুলোর নেতা-কর্মীরা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন—যদি এই দাবিগুলো নভেম্বরের মধ্যে কার্যকর না হয়, তবে তারা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ‘যমুনা’র সামনে অনির্দিষ্টকালের অবস্থান কর্মসূচি শুরু করবেন।
বুধবার (১২ নভেম্বর) রাজধানীর মগবাজারের আল-ফালাহ মিলনায়তনে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ ঘোষণা দেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, “আমরা জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন ও গণভোট আয়োজনের দাবিতে আন্দোলনে যাচ্ছি। এই দাবিগুলো শুধু আমাদের নয়, সমগ্র জাতির দাবি।”
প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, ইসলামী যুব আন্দোলন, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জাতীয় ইসলামী ঐক্য ফ্রন্ট এবং ইসলামিক পলিটিক্যাল কাউন্সিলের নেতারা। তারা জানান, গত জুলাইয়ে ঘোষিত ‘জাতীয় সনদ’ দেশের রাজনৈতিক সংস্কারের একটি ঐক্যবদ্ধ নীলনকশা, যা বাস্তবায়িত হলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে।
সনদের মূল দফাগুলোর মধ্যে রয়েছে—
১. জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে গণভোট আয়োজন,
২. অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থায় সর্বদলীয় অংশগ্রহণ,
৩. রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া সংস্কার,
৪. নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, এবং
৫. দুর্নীতিবিরোধী ও মানবাধিকার সুরক্ষা আইনের কার্যকর প্রয়োগ।
অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, “আমরা দেখেছি, ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলো সব সময় জনগণের মতামত উপেক্ষা করে নির্বাচনের নামে প্রহসন চালিয়েছে। এবার আর জনগণ তা মেনে নেবে না। এই সনদ বাস্তবায়ন না হলে যমুনার সামনে বসে আমৃত্যু অনশনেও যেতে আমরা প্রস্তুত।”
সংবাদ সম্মেলনে দলগুলো তিন ধাপের কর্মসূচি ঘোষণা করে।
প্রথম ধাপে ১৩ নভেম্বর দেশব্যাপী “রাজপথে অবস্থান কর্মসূচি” পালিত হবে। এদিন তারা “ফ্যাসিবাদী শক্তির নাশকতা ও অপতৎপরতা প্রতিরোধে” সর্বস্তরের জনশক্তিকে রাজপথে নামানোর আহ্বান জানিয়েছে। মুজিবুর রহমান বলেন, “এই দেশকে মুক্তি দিতে হলে সবাইকে রাজপথে আসতে হবে—কেবল বক্তৃতায় নয়, জনগণের শক্তিতে।”
দ্বিতীয় ধাপে ১৪ নভেম্বর সারাদেশে জেলা ও মহানগর পর্যায়ে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। এই মিছিলে “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি ও গণভোট আয়োজনের” দাবি প্রধান এজেন্ডা হিসেবে থাকবে।
তৃতীয় ধাপে ১৬ নভেম্বর ৮ দলের শীর্ষ নেতাদের এক যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে সরকার দাবিগুলো মানছে কিনা তা মূল্যায়ন করে পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে। দলগুলো হুঁশিয়ারি দিয়েছে—যদি তখনও সরকার ইতিবাচক সাড়া না দেয়, তবে তারা “প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় যমুনার সামনে অনির্দিষ্টকালের অবস্থান কর্মসূচি” শুরু করবে।
জামায়াত নেতা অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, “দেশের জনগণ এখন সচেতন। তারা জানে, নির্বাচনের নামে কেমন প্রহসন হয়। আমরা চাই গণভোট—যেখানে মানুষ নিজের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারবে। আর যদি সরকার আমাদের দাবি মানতে অস্বীকার করে, তাহলে আমরা এমন গণআন্দোলন গড়ে তুলব, যা উপেক্ষা করা অসম্ভব হবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কোনও সংঘর্ষ চাই না। কিন্তু জনগণের অধিকার কেড়ে নেওয়া হলে, রাজপথে প্রতিরোধ গড়ে তুলব। যমুনার সামনে বসে আমরা দেখিয়ে দেব—এই দেশের মালিক জনগণ, কোনও গোষ্ঠী বা প্রভাবশালী পরিবার নয়।”
অন্যদিকে ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা ইউনুস আহমদ বলেন, “এই সরকার ও তার উপদেষ্টা পরিষদ দেশকে একদলীয় শাসনে ঠেলে দিচ্ছে। ইসলামী ৮ দল জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া কোনও সরকার মেনে নেবে না।”
আগামী বছরের প্রথম প্রান্তিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও, এখনো রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অনুপস্থিতি ও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিরোধী দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসলামী ৮ দলের এই অবস্থান নতুন রাজনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. নাসির উদ্দিন বলেন, “জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে প্রান্তিক অবস্থায় থাকলেও, ‘জুলাই সনদ’ তাদের এক নতুন ঐক্য প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে। এই সনদের মাধ্যমে তারা শুধু রাজনৈতিক স্বীকৃতি নয়, বরং গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার ভূমিকা নিতে চাইছে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি সরকার গণভোটের দাবিকে উপেক্ষা করে, তাহলে এই জোট আরও বড় আকারে সম্প্রসারিত হতে পারে, যেখানে অন্যান্য বিরোধী দলও যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
জামায়াত সূত্রে জানা গেছে, “যমুনার সামনে অবস্থান কর্মসূচি”র জন্য ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। রাজধানী ও আশপাশের জেলাগুলো থেকে নেতা-কর্মীদের নামের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই কর্মসূচি হবে অনির্দিষ্টকালের জন্য, যেখানে দিন-রাত অবস্থান চালিয়ে যাওয়া হবে যতক্ষণ না সরকার দাবি মেনে নিচ্ছে।
জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করব। কিন্তু যদি সরকার বাধা দেয়, তাহলে আন্দোলন অন্য মাত্রা পাবে। এইবার আমাদের লক্ষ্য একটাই—গণভোট এবং জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন।”
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে ইসলামী ৮ দলের এই ঘোষণা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। সরকার এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে প্রশাসনের একাধিক সূত্র জানায় যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাজধানী ও সংবেদনশীল স্থানে বিশেষ নজরদারি শুরু করেছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এই আন্দোলন যদি গণআন্দোলনে রূপ নেয়, তাহলে তা আসন্ন নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে। এখন দেখার বিষয়—সরকার এই দাবিগুলোকে সংলাপের পথে সমাধান করবে নাকি সংঘাতের পথে যাবে।
এদিকে, জামায়াত ও ইসলামী জোটের নেতারা স্পষ্ট করে বলেছেন, “যদি জনগণের কণ্ঠস্বর দমন করা হয়, তাহলে এবার যমুনার সামনে নয়—সারা বাংলাদেশই হবে রাজপথ।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



