ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম নগরীতে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী তৎপরতা, অবৈধ অস্ত্রের বিস্তার এবং রাজনৈতিক সহিংসতার প্রেক্ষাপটে এবার কঠোর অবস্থানে গেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। শহরের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশকে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ।
তিনি স্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন—“অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বা আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী কাউকে দেখামাত্রই ব্রাশফায়ার করা হবে।” অর্থাৎ অস্ত্র হাতে পাওয়া মাত্রই পুলিশ সরাসরি গুলি চালাবে—কোনো প্রকার সতর্কবার্তা বা বিলম্ব ছাড়াই।
মঙ্গলবার দুপুরে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ ওয়্যারলেস সেটে পুলিশের সকল ইউনিট—টহল দল, থানা, গোয়েন্দা বিভাগ ও বিশেষ ইউনিটগুলোকে এই মৌখিক নির্দেশ দেন। দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট থেকে ১টার মধ্যে কয়েক দফায় দেওয়া এই নির্দেশনার মাধ্যমে কমিশনার চট্টগ্রাম নগরীতে চলমান পুলিশি অভিযানের কৌশলে বড় পরিবর্তন আনেন।
পরে রাতে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে তিনি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেন। হাসিব আজিজ বলেন, “চট্টগ্রামকে অন্ধকারের যুগে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কিছু অস্ত্রধারী অপরাধী, রাজনৈতিক ছদ্মবেশে, নগরীর শান্তি-শৃঙ্খলাকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে। আমরা তা কোনোভাবেই হতে দেব না। যদি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কয়েকজনকে মেরে ফেলতে হয়—আমরা তা করব। চট্টগ্রামকে আর জাহেলিয়াতের যুগে ফিরতে দেওয়া হবে না।”
তার এই বক্তব্য সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তীব্র আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কারণ, এটি একদিকে পুলিশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির স্পষ্ট ঘোষণা, অন্যদিকে আইনি প্রক্রিয়া ও মানবাধিকার প্রশ্নেও নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
সূত্রে জানা গেছে, কমিশনার হাসিব আজিজ বেতার বার্তায় বলেছেন— “শটগান হবে না, চায়না রাইফেলও বাদ। এখন এসএমজি ব্রাশফায়ার মুডে থাকবে।”
অর্থাৎ, সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় পুলিশ এখন থেকে এসএমজি (Sub Machine Gun) ব্যবহার করবে—যা একসাথে একাধিক বুলেট নিক্ষেপ করতে সক্ষম এবং স্বল্প সময়ে লক্ষ্যবস্তু নিস্তেজ করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
বেতার বার্তায় আরও বলা হয়েছে, টহল দলগুলো এখন থেকে এসএমজি ছাড়াও শিশা শটগান, দুটি গ্যাসগান, এবং টিম ইনচার্জের কাছে নাইন এমএম পিস্তল রাখতে হবে। এর পাশাপাশি চট্টগ্রাম নগরজুড়ে স্থায়ী চেকপোস্টের সংখ্যা ৭ থেকে বাড়িয়ে ১৩টি করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
এর ফলে পুরো শহরে পুলিশের টহল কার্যক্রম আরও ঘন হবে, বিশেষ করে রাতে গুরুত্বপূর্ণ মোড়, মহাসড়ক ও রাজনৈতিক কর্মসূচির আশপাশে থাকবে বিশেষ নজরদারি।
বেতার বার্তায় কমিশনার হাসিব আজিজ তার অধীনস্থ সদস্যদের মনে করিয়ে দেন, বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৯৬ থেকে ১০৬ ধারা পর্যন্ত পুলিশ সদস্যদের আত্মরক্ষার পূর্ণ আইনি অধিকার প্রদান করে। তিনি স্পষ্ট করে বলেন— “কোনো পুলিশ সদস্য আত্মরক্ষায় অস্ত্র ব্যবহার করলে তার দায় আমি নেব। তোমরা দ্বিধা করবে না।”
এই বক্তব্য পুলিশ সদস্যদের মাঝে মনোবল বাড়িয়েছে বলে জানা গেছে। কারণ, সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক ঘটনায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে পুলিশ সদস্য আহত বা নিহত হয়েছেন, অথচ গুলি চালানোর পর তাদের ওপর তদন্ত বা মামলা হয়েছে—যা পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল।
চট্টগ্রাম নগরে সাম্প্রতিক সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে ৫ নভেম্বর। সেদিন বায়েজিদ বোস্তামী থানার চালিতাতলীর খন্দকারপাড়া এলাকায় বিএনপির প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগ চলাকালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন সিএমপির তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা। একই ঘটনায় আহত হন এরশাদ উল্লাহ নিজেও।
এর পরদিন একই এলাকায় ফের গুলির ঘটনা ঘটে, যেখানে আরও একজন আহত হন। স্থানীয়দের অভিযোগ, এলাকায় পুনরায় সক্রিয় হয়েছে পুরনো অপরাধচক্র, যারা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করছে।
এই দুটি ঘটনার পর থেকে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসায়ীরা রাতের বেলা দোকান আগে বন্ধ করতে শুরু করেন, অনেক এলাকায় টহল বাড়ানো হয়। পুলিশ প্রশাসনও বুঝতে পারে, সন্ত্রাসীরা নতুন করে অস্ত্র হাতে নিচ্ছে।
ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতেই কমিশনারের এই কঠোর নির্দেশনা আসে।
এটি সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজের প্রথম এমন নির্দেশ নয়। এর আগে ২০২৫ সালের ১৩ আগস্ট, বন্দর থানায় আওয়ামী লীগের মিছিলকে কেন্দ্র করে অভিযানে যাওয়া এক পুলিশ কর্মকর্তাকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনার পরও তিনি ‘দেখামাত্র গুলি’ নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সেই সময়ও ওয়্যারলেস সেটে দেওয়া ওই নির্দেশ বেতার বার্তা হিসেবে ফাঁস হয়, যা পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই ঘটনায় পুলিশ সদস্য অমি দাশকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে মামলা হয় ‘বিনা অনুমতিতে রেকর্ড ও প্রচারের’ অভিযোগে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগস্টের ঘটনার পর চট্টগ্রামে অস্ত্রধারী গোষ্ঠীগুলো কিছুটা স্তব্ধ হলেও, নভেম্বর মাসে ফের তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবার তাই কমিশনারের নির্দেশ আরও কঠোর—“অস্ত্র দেখামাত্র ব্রাশফায়ার”।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন অত্যন্ত সংবেদনশীল। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচি, নির্বাচনী প্রচারণা এবং প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা ঘিরে অস্ত্রধারী গোষ্ঠীগুলো ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মত।
পুলিশের তথ্যমতে, নগরীর বন্দর, পতেঙ্গা, বায়েজিদ, বাকলিয়া ও কর্ণফুলী এলাকায় দুই ডজনের বেশি সক্রিয় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মধ্যে কয়েকটি গোষ্ঠী সরাসরি রাজনৈতিক আশ্রয়ে কাজ করছে। এসব গোষ্ঠীর কাছে দেশীয় তৈরি অস্ত্র ছাড়াও বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র থাকার তথ্যও পাওয়া গেছে।
এই প্রেক্ষাপটেই সিএমপি কমিশনারের নির্দেশকে অনেকে “দ্রুত প্রতিক্রিয়া কৌশল” হিসেবে দেখছেন।
সিএমপি সূত্র জানায়, কমিশনারের নির্দেশ অনুযায়ী ইতোমধ্যেই নগরজুড়ে ১৩টি স্থায়ী ও ২২টি অস্থায়ী চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে র্যাব, ডিবি ও সিআইডির সদস্যরাও যৌথভাবে কাজ করছেন।
শহরের প্রবেশ ও বহির্গমন পথ—যেমন অক্সিজেন মোড়, শিকলবাহা, কর্ণফুলী ব্রিজ, এবং সিটি গেট এলাকায় গাড়ি তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। কোনো যানবাহনে অস্ত্র বা বিস্ফোরক সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্রাশফায়ারের প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়েছে।
এদিকে মানবাধিকার কর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞরা বিষয়টিকে উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, “দেখামাত্র গুলি” নীতি আইনের শাসনের পরিপন্থী হতে পারে, যদি এটি যথাযথ প্রমাণ ছাড়া প্রয়োগ করা হয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শহিদুল ইসলাম বলেন, “পুলিশের আত্মরক্ষার অধিকার অবশ্যই আছে। তবে প্রতিটি গুলির ঘটনার বিচার হওয়া উচিত—তা ন্যায্য আত্মরক্ষা ছিল কি না, তা যাচাই করা জরুরি।”
তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, সন্ত্রাসীদের হাতে পুলিশ মারা গেলে বা আহত হলে জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। তাই অস্ত্রধারীদের ক্ষেত্রে এখন কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না।
রাতে সাংবাদিকদের এক সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, “অস্ত্র হাতে যারা মানুষ হত্যা করে, তারা মানবাধিকার হারিয়েছে। পুলিশ জনগণের জানমাল রক্ষায় কাজ করছে। এই শহরকে আবার অপরাধীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে না। আমরা কঠোর হবো, প্রয়োজনে প্রাণঘাতী হবো।”
তিনি আরও বলেন, “চট্টগ্রাম একসময় সন্ত্রাসের শহর হিসেবে পরিচিত ছিল। বহুদিন পর এই শহর আবার শান্ত হয়েছিল। এখন যারা সেই অন্ধকার ফিরিয়ে আনতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।”
চট্টগ্রামে পুলিশের এই নতুন নির্দেশ law enforcement ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি যেমন নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি বহন করে, তেমনি মানবাধিকার, বিচার প্রক্রিয়া ও ন্যায্যতার প্রশ্নেও নতুন বিতর্ক তৈরি করেছে।
নগরবাসীর আশা—অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের দমন করতে গিয়ে যেন নিরীহ নাগরিক বা ভুল তথ্যের ভিত্তিতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তবে পুলিশ বাহিনীর বার্তা এখন স্পষ্ট—চট্টগ্রামে সন্ত্রাসের জায়গা নেই, অস্ত্রধারী দেখলেই ব্রাশফায়ার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



