ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে যাদের নাম চিরকাল অক্ষয় থাকবে, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নিঃসন্দেহে তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ২৫ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে অসংখ্য রেকর্ড, গোল, শিরোপা এবং অনুপ্রেরণার গল্প উপহার দিয়েছেন এই পর্তুগিজ মহাতারকা। কিন্তু এখন সময়টা যেন বিদায়ের ঘন্টাধ্বনি বাজিয়ে দিচ্ছে। নিজের মুখেই রোনালদো জানালেন— “আমি দ্রুতই অবসর নেব।”
৪০ বছর বয়স পেরিয়ে যাওয়া এই তারকার সামনে এখনো ফুটবল মাঠের লড়াই চলছে, তবে আর বেশি দিন নয়। মাস তিনেকের মধ্যেই পূর্ণ হবে তাঁর ৪১ বছর। তবুও তিনি এখনো সৌদি আরবের আল নাসর ক্লাবের হয়ে নিয়মিত খেলছেন, গোল করছেন, নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলকে।
সম্প্রতি একটি ভিডিও সাক্ষাৎকারে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন রোনালদো। সেখানে হাস্যরস মিশিয়ে তিনি বলেন, “আমি সত্যিই এখনকার মুহূর্তটা উপভোগ করছি। আমি এখনো গোল করছি, নিজেকে দ্রুত, শক্তিশালী এবং মনোযোগী অনুভব করছি। তবে হ্যাঁ, আমি শিগগিরই অবসর নেব। হয়তো ১০ বছরের মধ্যে... (হেসে) না না, মজা করলাম! সত্যি বলতে, এক বা দুই বছরের মধ্যেই আমি ফুটবলকে বিদায় জানাব।”
তিনি আরও বলেন, “গত ২৫ বছরে আমি ফুটবলের জন্য যা করতে পারতাম, সব করেছি। আমি ফুটবলকে আমার জীবন, আমার শক্তি, আমার ভালোবাসা—সবকিছুই দিয়েছি। তাই মনে হচ্ছে, এবার বিশ্রাম নেওয়ার সময় এসেছে।”
২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত হবে ফিফা বিশ্বকাপ। সেটিই হবে রোনালদোর ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট—তিনি নিজেই সেটি নিশ্চিত করেছেন। “এটাই হবে আমার শেষ বিশ্বকাপ,” বলেন তিনি, “আমি জানি আমার শরীর এখনো ফিট, কিন্তু সময় কারো জন্য থেমে থাকে না। আমি চাচ্ছি, মাঠ ছাড়ার সময় যেন মানুষ আমাকে সেরাদের একজন হিসেবে মনে রাখে, ক্লান্ত বা ধীর খেলোয়াড় হিসেবে নয়।”
আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলদাতা রোনালদোর নামের পাশে এখন পর্যন্ত ১২৯টি আন্তর্জাতিক গোল। ২০০৩ সালে পর্তুগালের হয়ে অভিষেক হওয়ার পর থেকে তিনি খেলেছেন ২০ বছরেরও বেশি সময়। এ সময় তিনি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ (২০১৬) ও উয়েফা নেশনস লিগ (২০১৯) জিতেছেন, যা পর্তুগালের ফুটবল ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করে।
ক্লাব ফুটবলেও তাঁর অর্জন কিংবদন্তির চেয়েও বেশি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস, স্পোর্টিং লিসবন এবং বর্তমানে আল নাসরের হয়ে খেলেছেন তিনি। রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে করেছেন ৪৫০ গোল, জিতেছেন চারটি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা। ক্যারিয়ারে মোট পাঁচবার জয় করেছেন ব্যালন ডি’অর—যা ফুটবলের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সম্মান।
তাঁর গোলসংখ্যা এখন পেশাদার ফুটবলে প্রায় এক হাজারের কাছাকাছি। বর্তমানে তিনি সেই ঐতিহাসিক মাইলফলক থেকে মাত্র ৪৭ গোল দূরে। অনেকের ধারণা, এই মাইলফলক স্পর্শ করেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় বলবেন ফুটবলকে।
যদিও অবসরের কথা বলছেন রোনালদো, মাঠে তাঁর পারফরম্যান্স এখনো অবাক করার মতো ধারালো। সৌদি প্রো লিগে তিনি এখনো সর্বোচ্চ গোলদাতাদের একজন। প্রতিটি ম্যাচে তাঁর উপস্থিতি গ্যালারিতে এনে দেয় এক অন্য রকম উন্মাদনা।
“আমি এখনো প্রতিদিন অনুশীলন করি, এখনো নতুন প্রজন্মের খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি,” বলেন তিনি। “তবে আমি জানি, চিরকাল এটা চলবে না। আমার লক্ষ্য—সন্মানের সঙ্গে বিদায় নেওয়া, এমন এক মুহূর্তে যখন আমি এখনো মাঠে প্রভাব রাখতে পারি।”
রোনালদো জানিয়েছেন, তিনি এখন পরিবার, সন্তান ও নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ভাবছেন। ফুটবল ছাড়ার পরও খেলাধুলার জগতের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান তিনি। তাঁর নিজের ‘CR7’ ব্র্যান্ড ইতোমধ্যেই বিশ্বব্যাপী সফল, যার অধীনে রয়েছে পোশাক, সুগন্ধি, ফিটনেস সেন্টার এবং হোটেল ব্যবসা।
তিনি বলেন, “ফুটবল আমাকে সবকিছু দিয়েছে। এবার আমি সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই মাঠের বাইরে। আমি চাই তরুণরা আমার যাত্রা থেকে অনুপ্রেরণা নিক—যেভাবে একজন সাধারণ ছেলেও বিশ্বজয় করতে পারে।”
রোনালদোর সাবেক কোচ ও কিংবদন্তি ফুটবলার জিনেদিন জিদান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “ক্রিস্টিয়ানো এমন একজন, যাকে ফুটবল ইতিহাস কখনো ভুলবে না। তাঁর মানসিক দৃঢ়তা, শৃঙ্খলা ও নিবেদন এককথায় অনন্য। তিনি যখনই অবসর নেবেন, সেই দিনটি হবে ফুটবল বিশ্বের জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।”
রোনালদোর ক্যারিয়ারে একমাত্র অনুপস্থিত ট্রফিটি হলো ফিফা বিশ্বকাপ। অনেকেই মনে করেন, ২০২৬ সালের আসর তাঁর জন্য শেষ সুযোগ হবে এই স্বপ্ন পূরণের। একইসঙ্গে পেশাদার ফুটবলে ১,০০০ গোলের মাইলফলকও ছোঁয়া সম্ভব তাঁর জন্য। বর্তমানে সেই লক্ষ্য থেকে তিনি মাত্র ৪৭ গোল দূরে।
বিশ্লেষকদের মতে, তাঁর বর্তমান ফিটনেস ও পারফরম্যান্স দেখে মনে হচ্ছে, রোনালদো সহজেই এই লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন। আর যদি তা হয়, তবে ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে এই অর্জন রোনালদোর নামেই লেখা থাকবে।
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো শুধু একজন ফুটবলার নন, তিনি এক প্রজন্মের প্রতীক। তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি অনুশীলন, প্রতিটি গোল ফুটবলপ্রেমীদের জন্য অনুপ্রেরণা। হয়তো তিনি শিগগিরই মাঠকে বিদায় জানাবেন, কিন্তু তাঁর ছাপ থাকবে প্রতিটি ফুটবল মাঠে, প্রতিটি শিশুর স্বপ্নে।
“আমি যা করতে চেয়েছিলাম, সব করেছি,” বলেন রোনালদো। “এখন সময় এসেছে ধীরে ধীরে অন্য পথে হাঁটার। কিন্তু ফুটবল আমার হৃদয়ে থাকবে চিরদিন।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



