ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বিচার বিভাগে আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে নতুন করে ২২ জন বিচারপতিকে স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে আজ বুধবার (১২ নভেম্বর) দুপুর দেড়টায়। নতুন স্থায়ী বিচারকদের শপথ পড়াবেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) রাতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, নিয়োগপ্রাপ্ত ২২ জন বিচারপতি আজ দুপুরে শপথ নেবেন প্রধান বিচারপতির উপস্থিতিতে। শপথ অনুষ্ঠানটি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে এই শপথ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যেই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে এক ধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা দিয়েছে। বিচারপতি, আইনজীবী, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন মহলের প্রতিনিধিরা আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বিএনপির নেতা ও সাবেক উপদেষ্টা নিতাই রায় চৌধুরীর পুত্র বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীকে আপাতত স্থায়ী করা হয়নি। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁর বয়স এখনো ৪৫ বছর পূর্ণ হয়নি। তবে তিনি বয়সসীমা পূর্ণ করার পর স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাবেন বলে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তটি আইনজীবী মহলে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। অনেকেই বলছেন, বয়সের বিধান সংবিধান অনুযায়ী হলেও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই সিদ্ধান্তটি নতুন বিতর্কের জন্ম দিতে পারে। কারণ, ২০২৪ সালের ৯ অক্টোবর যখন ২৩ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ পান, তখন দেবাশীষ রায় চৌধুরীও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। কিন্তু স্থায়ী নিয়োগের সময় তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। ফলে ২২ জন বিচারক স্থায়ী নিয়োগ পেলেও, একমাত্র তিনিই আপাতত স্থায়ী হচ্ছেন না।
স্থায়ী হওয়া বিচারকদের নামের তালিকা
স্থায়ী নিয়োগ পাওয়া ২২ জন বিচারক হলেন—
১. বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার
২. বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেন
৩. বিচারপতি মো. মনসুর আলম
৪. বিচারপতি সৈয়দ জাহেদ মনসুর
৫. বিচারপতি কে. এম. রাশেদুজ্জামান রাজা
৬. বিচারপতি মো. যাবিদ হোসেন
৭. বিচারপতি মুবিনা আসাফ
৮. বিচারপতি কাজী ওয়ালিউল ইসলাম
৯. বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকা
১০. বিচারপতি মো. আবদুল মান্নান
১১. বিচারপতি তামান্না রহমান খালিদী
১২. বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ
১৩. বিচারপতি মো. হামিদুর রহমান
১৪. বিচারপতি নাসরিন আক্তার
১৫. বিচারপতি সাথীকা হোসেন
১৬. বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তাজরুল হোসেন
১৭. বিচারপতি মো. তৌফিক ইনাম
১৮. বিচারপতি ইউসুফ আব্দুল্লাহ সুমন
১৯. বিচারপতি শেখ তাহসিন আলী
২০. বিচারপতি ফয়েজ আহমেদ
২১. বিচারপতি মো. সগীর হোসেন
২২. বিচারপতি শিকদার মাহমুদুর রাজী।
এই ২২ জনই ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। প্রায় এক বছরের পর্যবেক্ষণ শেষে তাঁদের স্থায়ী করা হলো।
সরকারি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শক্রমে এই নিয়োগ প্রদান করেছেন। প্রজ্ঞাপনে আরও উল্লেখ করা হয়, শপথ গ্রহণের তারিখ থেকে তাঁদের স্থায়ী নিয়োগ কার্যকর হবে। অর্থাৎ, আজকের শপথ অনুষ্ঠানের পর থেকেই তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে হাইকোর্ট বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করবেন।
সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির পরামর্শক্রমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের নিয়োগ দেবেন।” আর ৯৫(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, হাইকোর্টের বিচারপতি হতে হলে একজন প্রার্থীকে কমপক্ষে ১০ বছর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া বরাবরই আলোচনার বিষয় হয়ে আসছে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে প্রায়শই এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে মতবিরোধ তৈরি হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বিচার বিভাগে সংস্কার ও পুনর্গঠন নিয়ে সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। ২২ বিচারপতির স্থায়ী নিয়োগ সেই ধারাবাহিকতার অংশ।
আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার ফারুক আহমেদ বলেন, “এটি সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি ইতিবাচক ঘটনা। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচন নিশ্চিত করা জরুরি। বয়স বা রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে কারও বাদ পড়া বা অন্তর্ভুক্তি যেন বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে।”
অন্যদিকে, কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী মনে করছেন, এই নিয়োগের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক সংকট কিছুটা লাঘব হবে। বর্তমানে হাইকোর্টে প্রায় ৮৫ জন বিচারপতি দায়িত্ব পালন করছেন। নতুন ২২ জন যুক্ত হলে বিচারপ্রক্রিয়া আরও গতিশীল হবে বলে তারা আশা করছেন।
আজকের শপথ অনুষ্ঠান শেষে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিরা আগামীকাল থেকেই তাদের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। তাঁদের জন্য ইতোমধ্যেই আদালতের ক্যালেন্ডার ও রোস্টার প্রস্তুত করা হয়েছে। বিচারপতিরা প্রধানত নাগরিক, দেওয়ানি, ফৌজদারি এবং সাংবিধানিক মামলার শুনানি পরিচালনা করবেন।
সুপ্রিম কোর্টে ২২ জন বিচারপতির স্থায়ী নিয়োগ শুধু বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে না, বরং দেশের বিচার ব্যবস্থায় নতুন উদ্দীপনা আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। আজকের শপথের মাধ্যমে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিচার বিভাগের গতি আরও দ্রুত হবে বলে আদালত সংশ্লিষ্ট মহলের প্রত্যাশা।
সরকার ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এই নিয়োগ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকর প্রশাসন নিশ্চিত করার পথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



