
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ সরকার জাপানের কাছে বাজেট সহায়তা, সহজ শর্তে ঋণ এবং ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধির অনুরোধ জানিয়েছে। এই অনুরোধ করা হয় বৃহস্পতিবার জাপানের রাজধানী টোকিওতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ও জাপানের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ষষ্ঠ ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) বৈঠকে। বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্য, উন্নয়ন প্রকল্প, রোহিঙ্গা সংকট এবং আঞ্চলিক কৌশলগত অংশীদারত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাপানকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাপে দেশের বাজেট ভারসাম্য রক্ষা করতে জাপানের কাছ থেকে আরও বাজেট সহায়তা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে আগের ওডিএ (Official Development Assistance) ঋণগুলো যাতে সহজ শর্তে পুনঃপরিশোধের সুযোগ পাওয়া যায়—তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানানো হয়। বিশেষ করে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো ও সুদের হার কমানোর আহ্বান জানায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে বৈদেশিক ঋণের চাপ, ডলার সংকট, ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নিম্নগতি মোকাবিলা করছে। এই পরিস্থিতিতে বাজেট সহায়তা হিসেবে জাপানের মতো নির্ভরযোগ্য অংশীদার দেশের অর্থনৈতিক সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বৈঠকে জাপান তার অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে জানায়, তারা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও এর সংস্কার উদ্যোগগুলোর প্রতি সমর্থন দিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। দুই দেশই তাদের মধ্যে বিদ্যমান “কৌশলগত অংশীদারত্ব”কে আরও সুসংহত করার বিষয়েও একমত হয়।
জাপান বলেছে, তারা শুধু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে নয়, বরং উন্নয়ন কৌশলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সহায়তা করতে আগ্রহী। বিশেষ করে, বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ (BIG-B) এর আওতায় উচ্চ মানসম্পন্ন অবকাঠামো নির্মাণে জাপান বাংলাদেশের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
বাংলাদেশ ২০২6 সালে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের পর অনেক বাণিজ্য সুবিধা হারাতে পারে—এমন শঙ্কা থেকে এফওসি বৈঠকে বাংলাদেশি পণ্যের জাপানে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ। জাপান ইতিবাচকভাবে বিষয়টি গ্রহণ করেছে বলে জানানো হয়।
এছাড়া বাংলাদেশি ফলমূল ও সবজি জাপানি বাজারে প্রবেশের পথ সহজ করতে দুই দেশ একযোগে কাজ করবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। এই উদ্যোগ দেশের কৃষি খাতে বৈদেশিক বাজার সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
দুই দেশের মধ্যে Economic Partnership Agreement (EPA) চুক্তির অগ্রগতি নিয়েও সন্তোষ প্রকাশ করা হয়। উভয় পক্ষই আশা করছে, চলতি বছরের মধ্যেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। ইপিএ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশি পণ্য জাপানের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, পাশাপাশি জাপান থেকে বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি স্থানান্তরও আরও বাড়বে।
জাপান বৈঠকে জানায়, তারা তাদের শিল্পকারখানা ও সরবরাহ চেইনের অংশ বাংলাদেশে স্থানান্তর করতে আগ্রহী। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তি দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে।
বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। জাপান জানায়, তারা রোহিঙ্গা পুনর্বাসন ও প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে প্রস্তুত। এই সংকটে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অত্যন্ত জরুরি বলে উভয় পক্ষ একমত হয়।
বৈঠকে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আসন্ন জাপান সফর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ইউনূসের এই সফর দুই দেশের মধ্যে সামাজিক ব্যবসা, গ্রামীণ অর্থনীতি ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার নতুন দিক উন্মোচনে সহায়ক হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
এই ফরেন অফিস কনসালটেশন বৈঠক দুই দেশের কৌশলগত সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় জাপানের মতো অংশীদার দেশের সঙ্গে এমন কার্যকর সংলাপ বাংলাদেশের উন্নয়ন কৌশল ও বাজেট ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ