
ছবি: সংগৃহীত
আজ ১ মে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মহান মে দিবস। বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণে দিনটি পালিত হয় অনাড়ম্বর মর্যাদায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এই দিবসটির তাৎপর্য অনস্বীকার্য—কারণ দেশের অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির বড় অংশই শ্রমজীবী মানুষের কাঁধে ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারি ছুটি উপলক্ষে আজ দেশজুড়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও, গতি থেমে নেই শ্রমিক অধিকার, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনের দাবিতে নানা কর্মসূচিতে।
এ বছরের প্রতিপাদ্য—‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’, সময়োপযোগী ও বার্তাবাহী। এটি শুধু দিবসের শ্লোগান নয়, বরং একটি অভিযাত্রার ডাক—যেখানে উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায় ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মাঝে সমতা ও শ্রদ্ধার সেতুবন্ধন গড়ে উঠবে।
মহান মে দিবস উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক বাণীতে বলেন, “শ্রমিক-মালিক পরস্পরের পরিপূরক শক্তি। এদের যৌথ প্রচেষ্টা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।”
তিনি আরও বলেন, “পোশাক শিল্প, কৃষি, নির্মাণ, পরিবহণ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্প খাত—সবক্ষেত্রেই শ্রমিকের পরিশ্রম আর মালিকের উদ্যোগ দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। এখন দরকার পারস্পরিক শ্রদ্ধা, আস্থা ও সহমর্মিতার পরিবেশ আরও দৃঢ় করা।”
বিশেষ করে তিনি উল্লেখ করেন, “আমরা যদি ঐক্য ও সহযোগিতার ধারাকে টিকিয়ে রাখি, তাহলে আগামী জুলাই-আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নও বাস্তবে রূপ নিতে পারে।”
চলতি বছর মহান মে দিবসের পাশাপাশি আজ জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি দিবস ২০২৫ পালিত হচ্ছে। ড. ইউনূস বলেন, “নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ শ্রমিকের অধিকারই নয়, এটি শিল্পের স্থায়িত্ব ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত।”
শ্রমিকের ন্যায্য স্বীকৃতি, সামাজিক সুরক্ষা ও জীবনমান উন্নয়ন না হলে শিল্পোন্নয়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই বার্তাই আজ পুনর্ব্যক্ত করা হচ্ছে।
১৮৮৬ সালের ১ মে, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কয়ারে হাজারো শ্রমিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে অংশ নেন। এই সময় পুলিশের ওপর বোমা বিস্ফোরণ হলে, পুলিশ গুলি চালায় শ্রমিকদের ওপর। প্রাণ হারান ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ সদস্য।
তাদের আত্মত্যাগ বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৮৯ সালে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের প্রস্তাব তোলা হয়, যা ১৮৯১ সালে গৃহীত হয়।
পরবর্তী সময়ে ১৯০৪ সালে আমস্টারডামে সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দিবসটি উদযাপনকে বাধ্যতামূলক কাজবিরতির অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তখন থেকেই ১ মে বিশ্বজুড়ে 'মে দিবস' হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করে। কমিশনটি সম্প্রতি ২১ এপ্রিল সরকারকে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা ও শ্রম পরিবেশ উন্নয়নে ২৫টি সুপারিশ, যার মধ্যে রয়েছে—
সর্বনিম্ন মজুরি নিশ্চিতকরণ
বেতন-বোনাস সময়মতো প্রদান
নিরাপদ কর্মপরিবেশ গঠনে বাধ্যতামূলক অডিট
নারীদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা ও নিরাপত্তা বিধান
ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে জটিলতা দূর করা
শ্রমিকদের জন্য আবাসন ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা
এগুলো বাস্তবায়ন হলে শুধু শ্রমিক নয়, দেশের অর্থনীতি এবং শিল্প খাতেও বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মে দিবস উপলক্ষে রাজনৈতিক নানা শ্রমিক সংগঠন পৃথক পৃথক কর্মসূচি পালন করছে। বিএনপির সহযোগী সংগঠন শ্রমিক দল দুপুরে নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামপন্থি বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন রাজধানীর পুরানা পল্টনে বড় শ্রমিক সমাবেশের আয়োজন করেছে। এই সমাবেশগুলোতে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে যুগোপযোগী কর্মসূচি ঘোষণা করা হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে জাতীয় দৈনিকগুলোতে আজ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার এবং বিভিন্ন বেসরকারি টিভি চ্যানেলও দিনব্যাপী বিশেষ আলোচনা, টকশো ও তথ্যচিত্র প্রচার করছে।
বিশেষজ্ঞ, পেশাজীবী এবং শ্রমিক নেতারা এই আলোচনা পর্বে অংশ নিচ্ছেন এবং বর্তমান শ্রম পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ ও করণীয় নিয়ে মত দিচ্ছেন।
বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা: শ্রমিক-মালিক ঐক্যই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন সময় শ্রমিক-মালিক সম্পর্ককে সহাবস্থানের উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার। উন্নত অর্থনীতিগুলোতে শ্রমিকের মর্যাদা, সামাজিক নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা ও সম্মানজনক পারিশ্রমিক নিশ্চিত করেই টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশে শ্রমিক শ্রেণি এখনও অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে—অবৈধ ছাঁটাই, বেতন বিলম্ব, ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপরিবেশ, নারী শ্রমিকের হয়রানি, শ্রম আদালতের দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি। এসব সমস্যার সমাধানে সরকার, মালিক এবং শ্রমিক—তিন পক্ষকেই যৌথভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
মহান মে দিবসের তাৎপর্য কেবল ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায় নয়, এটি ভবিষ্যতের পথে একটি নির্দেশনাও। একদিকে শ্রমিকদের রক্তে কেনা অধিকার, অন্যদিকে মালিকদের মেধা ও বিনিয়োগ—এই যুগল শক্তির সঠিক ব্যবস্থাপনা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটলে, বাংলাদেশ সত্যিই একদিন বৈষম্যহীন, টেকসই এবং মানবিক অর্থনীতির দেশ হয়ে উঠবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ