
ছবি: সংগৃহীত
ধ্বংসস্তূপের গাজা: পুনর্গঠনে সময় লাগবে কয়েক দশক, ব্যয় অন্তত ইসরাইলের টানা দুই বছরের রক্তক্ষয়ী আগ্রাসনের পর ফিলিস্তিনের উপকূলীয় অঞ্চল গাজা এখন এক গভীর মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র বহন করছে। শহর, গ্রাম, হাসপাতাল, স্কুল, বাজার—সবকিছুই এখন ভগ্নস্তূপে পরিণত। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ যৌথ মূল্যায়ন বলছে, গাজার এই ধ্বংসস্তূপ থেকে আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন হবে অন্তত ৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ফিলিস্তিনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পুনর্গঠন ব্যয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) আরও সতর্ক করে বলেছে, এই পুনর্গঠন কার্যক্রম সম্পূর্ণ করতে কয়েক দশক সময় লাগবে—এটি এক প্রজন্মেরও বেশি সময়ের লড়াই।
জাতিসংঘের হিসাবে, গাজার ধ্বংসাবশেষের পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি ৫০ লাখ টন, যা এক কথায় অকল্পনীয়। ইউএনডিপির বিশেষ প্রতিনিধি জাকো সিলার্স জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “যদি এই ধ্বংসস্তূপ নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে তা প্রায় ১২ মিটার (৪০ ফুট) উঁচু এক স্তূপ তৈরি করবে—অথবা মিশরের গিজায় ১৩টি বিশাল পিরামিড বানানোর মতো ইট-পাথর সেখানে রয়েছে।”
এই তথ্যের মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, গাজার উপর ইসরাইলি আগ্রাসনের পরিমাণ কতটা ভয়াবহ ছিল। ইউএনডিপির সেপ্টেম্বর মাসের জরিপে দেখা গেছে, যুদ্ধবিরতির আগে গাজার বেশিরভাগ এলাকায় ভূমিস্তর পর্যন্ত ধ্বংস নেমে এসেছে। ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের প্রাথমিক অনুমান ছিল ৫৩ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু নতুন প্রতিবেদনে সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭০ বিলিয়নে।
দুই বছরের এ যুদ্ধে ৬৭ হাজার ৮০০-রও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। আরও লাখো মানুষ আহত বা স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়েছেন। প্রায় দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষ—অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি—বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। হাসপাতালগুলো ধ্বংস, চিকিৎসক ও নার্সদের বড় অংশ নিহত বা আহত, আর ওষুধ ও সরঞ্জামের অভাব সর্বত্র। স্কুল, মসজিদ, বাজার—সবকিছুই বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত। কৃষিজমি পুড়ে গেছে, খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত, এবং জাতিসংঘ সতর্ক করেছে যে এখন সেখানে তীব্র খাদ্যসংকট ও অপুষ্টি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।
ইউএনডিপি জানিয়েছে, তারা এখন পর্যন্ত গাজা থেকে প্রায় ৮১ হাজার টন ধ্বংসাবশেষ অপসারণ করেছে, কিন্তু এটি মোট পরিমাণের সামান্য অংশ মাত্র। সিলার্স বলেন, “এই গতি বজায় রাখলেও গাজাকে ধ্বংসস্তূপমুক্ত করতে আমাদের আরও বহু বছর সময় লাগবে।”
জাতিসংঘের স্যাটেলাইট সেন্টার ইউনোস্যাট-এর সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ অনুসারে, গাজা সিটির ৮৩ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। পুরো শহরটি এখন পরিণত হয়েছে ধুলো ও ধ্বংসস্তূপের রাজ্যে। কোথাও কোথাও ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অসংখ্য মরদেহ পড়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, পুনর্গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে—অর্থাৎ আগামী তিন বছরের মধ্যেই—প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে, যা দিয়ে মূল অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, এবং অস্থায়ী বাসস্থান পুনর্গঠন শুরু করা যাবে। বাকি অর্থের প্রয়োজন হবে পরবর্তী দুই থেকে তিন দশকে।
দুই বছরের রক্তপাতের পর অবশেষে সোমবার (১৩ অক্টোবর) কার্যকর হয় এক নাজুক যুদ্ধবিরতি চুক্তি। এই চুক্তির আওতায় হামাস শেষ জীবিত ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তি দেয় এবং ইসরাইলও কয়েকশ ফিলিস্তিনি বন্দিকে ফিরিয়ে দেয়।
এই শান্তি প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তুরস্ক। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ঘোষণা করেছেন, তার সরকার এখন গাজা পুনর্গঠন ও মানবিক সহায়তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। শারম আল শেখ সম্মেলন থেকে ফেরার পথে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা উপসাগরীয় দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সমর্থন চাইব, এবং আমি আশাবাদী—দ্রুতই বড় আকারের অর্থায়ন শুরু হবে।”
এরদোগান বলেন, “গাজায় কনটেইনার ঘর পাঠানো এবং স্বাস্থ্যসেবা পুনরুদ্ধারে তুরস্ক প্রস্তুত। ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও আরব লীগের উদ্যোগে পুনর্গঠন প্রকল্পগুলোতে উল্লেখযোগ্য আর্থিক সহায়তা আসবে।”
তুরস্ক ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে, তারা যুদ্ধবিরতির পর গাজায় মোবাইল হাসপাতাল, পানিশোধন ইউনিট এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের জরুরি ব্যবস্থা পাঠাবে।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আরব বিশ্ব, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ সম্ভাব্য দাতাদের কাছ থেকে ইতিবাচক বার্তা পাওয়া গেছে। তবে এখনো নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি বা অঙ্ক প্রকাশ করা হয়নি।
বিশ্বব্যাংক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়েছে, গাজার পুনর্গঠন শুধু অর্থ নয়, বরং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপরও নির্ভর করছে। যদি ইসরাইল যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে আবার হামলা শুরু করে, তবে সমস্ত পুনর্গঠন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
এরদোগান এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, “ইসরাইলের চুক্তিভঙ্গের পুরোনো অভ্যাস রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে যুদ্ধবিরতি সত্যিকার অর্থে টিকে থাকে।”
আজকের গাজা কেবল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল নয়, এটি মানবতার পরীক্ষার মঞ্চে দাঁড়ানো এক প্রতীক। হাজার হাজার শিশু এখন ধুলোমাটির নিচে হারানো স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছে। তাদের জন্য শিক্ষা, নিরাপদ পানি ও চিকিৎসা—সবই এক বিলাসিতার নাম।
জাতিসংঘ বলছে, পুনর্গঠন শুধু ভবন নয়, একটি সমাজকে পুনর্গঠন করা। গাজার অর্থনীতি, অবকাঠামো ও মনুষ্যজীবন পুনরুদ্ধারে যে পরিমাণ সময় ও অর্থ দরকার, তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপ পুনর্গঠনের সময়ের চেয়েও বেশি হতে পারে।
তবু বিশ্ব যদি একত্রিত হয়ে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ডে আবার জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য এগিয়ে আসে, তবে হয়তো একদিন গাজার শিশুরা আবার শান্তিতে আকাশের তারা দেখতে পারবে—বোমার ঝলক নয়।
গাজা এখন ইতিহাসের এক ভয়াবহ ধ্বংসস্তূপ। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, পুনর্গঠনে লাগবে ৭০ বিলিয়ন ডলার, সময় লাগবে কয়েক দশক। প্রথম তিন বছরে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন ২০ বিলিয়ন ডলার। গাজার ৮৩ শতাংশ ভবন ধ্বংস, ৯০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত, এবং ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও পথ এখনও দীর্ঘ ও কণ্টকাকীর্ণ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ