
ছবি: সংগৃহীত
সুদীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইতিহাসে আবারও শুরু হচ্ছে গণতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়—রাকসু, হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন। ১৯৮৯ সালের পর আজ (বৃহস্পতিবার) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রত্যাশিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন।
এই নির্বাচনকে ঘিরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এখন উত্তেজনা, প্রত্যাশা ও সতর্কতার মিশ্র আবহে মুখরিত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বিত নিরাপত্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে পুরোপুরি। বিশেষ করে, এবার প্রথমবারের মতো ভোটে কারচুপি ঠেকাতে ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চালু করা হয়েছে ‘থ্রিডি সিকিউরিটি সিস্টেম’, যা বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনে এ পর্যন্ত সবচেয়ে উন্নত নিরাপত্তা কাঠামো বলে বিবেচিত হচ্ছে।
রাকসু নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে ২৮ হাজার ৯০১ জন ভোটার তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ভোট দেবেন। আর প্রার্থী রয়েছেন ৮৬০ জন—যাঁদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদের পাশাপাশি হল সংসদ ও সিনেট প্রতিনিধি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে।
ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯টি একাডেমিক ভবনে স্থাপিত ১৭টি ভোটকেন্দ্রে।
নির্বাচনের আগের দিন বুধবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে রাকসু নির্বাচন কমিশন। সেখানে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তিন স্তরের যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে ভোটারদের পরিচয় নিশ্চিত করার পরই তাঁদের ভোট দিতে দেওয়া হবে।
নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, “কারচুপি ঠেকাতে আমরা কেবল অমোচনীয় কালির ওপর নির্ভর করছি না। এবার থ্রিডি লেভেলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রথম ধাপে যাচাই করা হবে শিক্ষার্থী আইডি কার্ডের সত্যতা, দ্বিতীয় ধাপে দেখা হবে ইউনিক আইডি নম্বর, আর তৃতীয় ধাপে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা থেকে যাচাই শেষে ভোট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।”
তিনি আরও জানান, কোনো পর্যায়ে সন্দেহ দেখা দিলে বিশেষ কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে ভোটারের তথ্য মিলিয়ে দেখা হবে, যাতে জাল ভোট বা পরিচয় বিকৃতি একেবারেই অসম্ভব হয়।
রাকসু নির্বাচনে এবারই প্রথম ব্যবহার করা হচ্ছে আধুনিক ওএমআর (Optical Mark Recognition) মেশিন ও বিশেষায়িত সফটওয়্যার। ভোটের ফলাফল গণনায় থাকবে ৬টি ওএমআর মেশিন ও সমপরিমাণ স্ক্যানার, যা দিয়ে ভোট গণনা প্রক্রিয়া হবে সম্পূর্ণ ডিজিটাল ও দ্রুতগতির।
নির্বাচন কমিশনের আশা, মেশিনের সক্ষমতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১৭ ঘণ্টার মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের লক্ষ্য একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও বিতর্কমুক্ত নির্বাচন উপহার দেওয়া। প্রযুক্তিনির্ভর এই নিরাপত্তাব্যবস্থা আমাদের সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে।”
ভোটারের সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ব্যালট পেপার ছাপানো হয়েছে। প্রতিটি ব্যালটে থাকবে আলাদা সিরিয়াল নম্বর, যাতে গোপনীয়তা ও স্বচ্ছতা বজায় থাকে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, “আমরা ব্যালট মুদ্রণ থেকে বিতরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করেছি। কোনোভাবেই অতিরিক্ত ব্যালট ছাপানো হয়নি।”
ব্যালটগুলো এখন সংরক্ষিত রয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ে, এবং নির্ধারিত সময় অনুযায়ী প্রিজাইডিং অফিসারদের মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রে পাঠানো হবে।
রাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে নজিরবিহীনভাবে। ভোটের দিন ক্যাম্পাসে থাকবে ২,৩০০ পুলিশ সদস্য, ১২ প্লাটুন র্যাব ও ৬ প্লাটুন বিজিবি।
এর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি, রোভার স্কাউট ও স্টুডেন্ট কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের স্বেচ্ছাসেবকরা দায়িত্ব পালন করবেন।
গোটা ক্যাম্পাসে স্থাপন করা হয়েছে ১০০টি সিসিটিভি ক্যামেরা, যার মাধ্যমে প্রতিটি কেন্দ্র, প্রবেশপথ ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ২৪ ঘণ্টা নজরদারিতে থাকবে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আবু সুফিয়ান বুধবার রাবি ক্যাম্পাস পরিদর্শন শেষে বলেন, “আমরা নিরাপত্তা ঝুঁকির জায়গাগুলো পর্যালোচনা করেছি। পাশাপাশি সাইবার স্পেসে কোনো অপতথ্য বা প্রভাব বিস্তার যেন না ঘটে, সে জন্য একটি বিশেষ সাইবার টিমও কাজ করছে।”
তিনি আরও জানান, নির্বাচনের দিন বহিরাগতদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। “ক্যাম্পাসের সাতটি গেট খোলা থাকবে এবং প্রতিটি গেটেই নিরাপত্তা চেকপোস্ট থাকবে। কেউ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।”
রাকসু নির্বাচনের প্রশাসনিক ও কারিগরি দায়িত্বে থাকবেন ২১২ জন শিক্ষক, যাঁরা নির্বাচনের আগে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
ফলাফল প্রস্তুতিতে নিয়োজিত থাকবে ৪৩ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি। কমিশনার অধ্যাপক মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, “আমরা ডাকসু ও জাকসুর তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছি। তাড়াহুড়ো করে কোনো ভুল ফলাফল প্রকাশ করব না। ধীরস্থিরভাবে, নির্ভুলভাবে ফলাফল প্রস্তুত করব।”
কমিশনের লক্ষ্য—১৭ ঘণ্টার মধ্যেই ফলাফল প্রকাশ করা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচনের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য গঠন করেছে ১০ সদস্যের পর্যবেক্ষণ কমিটি। এর সভাপতির দায়িত্বে আছেন অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এম রফিকুল ইসলাম।
কমিটির কাজ হবে নির্বাচনকালীন বাস্তব চিত্র পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান। এই কমিটি নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই বিভিন্ন কেন্দ্রে ঘুরে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬২ সালে। ৬৩ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৪ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সর্বশেষ রাকসু নির্বাচন হয়েছিল ১৯৮৯ সালে—যখন দেশজুড়ে ছাত্ররাজনীতি উত্তাল ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে।
এরপর দীর্ঘ তিন দশক ধরে এই নির্বাচনের দাবি তুলেছে ছাত্রসমাজের নানা অংশ, কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও কোভিড পরবর্তী সময়ের প্রেক্ষাপটে তা বারবার স্থগিত হয়। অবশেষে ২০২৫ সালে এসে রাকসু নির্বাচন আবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা শিক্ষার্থী সমাজে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
রাকসু নির্বাচন কেবল নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া নয়; এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, শিক্ষার্থীদের অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতীক। দীর্ঘদিন পর এই নির্বাচন শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা ও রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ তৈরি করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, “রাকসু নির্বাচন পুনরুজ্জীবিত হওয়া মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের পুনর্জন্ম। আমরা চাই এটি স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক হোক।”
আজকের রাকসু নির্বাচন শুধু ভোট নয়—এটি তিন দশকের অপেক্ষা, এক প্রজন্মের প্রত্যাশা। কারচুপি ঠেকাতে ‘থ্রিডি সিকিউরিটি’, প্রযুক্তিনির্ভর ভোট গণনা ও নজিরবিহীন নিরাপত্তা বলয়ের মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আজ একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে।
যদি নির্বাচন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়, তবে এটি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার এক নতুন মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে—যেখান থেকে ভবিষ্যতের জাতীয় নেতৃত্বও উঠে আসবে বলে আশা করছে শিক্ষার্থীরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ