ছবি: সংগৃহীত
ব্যাংকগুলোকে লুকিয়ে রাখা খারাপ ঋণের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ করতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর ঋণ আদায় না করে নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দিচ্ছে না। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণের তথ্য বিদেশি অডিট ফার্মের মাধ্যমে যাচাই করা হচ্ছে। এই কারণে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫.৭৩ শতাংশ। জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ৬ লাখ ৮ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৪.৪০ শতাংশ।
বিশ্লেষকদের মতে, আগের সরকারের সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিসহায়তার সুযোগে খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন রাখার সুযোগ দিয়ে আসছিল। অনেক বড় ঋণগ্রহীতা ঋণসীমা বাড়িয়ে বা অন্য নামে ঋণ নিয়ে তা দিয়ে সমন্বয় করে অনাদায়ী ঋণ নিয়মিত দেখাত। তবে গত বছরের আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ সুযোগ বন্ধ হয়েছে। আগে মেয়াদি ঋণ অনাদায়ী হওয়ার ছয় মাস পর মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে ধরা হতো, কিন্তু গত মার্চ থেকে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ পার হওয়ার পরদিনই মেয়াদোত্তীর্ণ গণ্য করা হচ্ছে। এছাড়া বড় ব্যবসায়ীরা অনেকেই জেলে বা পলাতক আছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অন্যান্য কারণে অনেক খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলো প্রত্যাশিতভাবে ঋণ আদায় করতে পারছে না, যার ফলে খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়ে চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, কঠোরতার পাশাপাশি কোনো প্রকৃত ব্যবসায়ী যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঋণ আদায় জোরদারে একদিকে ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ রাখা হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু নীতি সহায়তা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে এখন খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণে বিশেষ এ সুবিধা মিলবে। আবার ঋণ অবলোপনের শর্ত শিথিল করে খেলাপি হওয়ার পরই তা আর্থিক বিবরণী থেকে আলাদা করে রাখার শর্ত শিথিল করা হয়েছে। অবশ্য ঋণ অবলোপনের জন্য ব্যাংকগুলোর মুনাফা থেকে শতভাগ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। আবার ভুয়া বা অন্য নামে নেওয়া ঋণে শিথিল শর্তে পুনঃতপশিল করার সুযোগ নেই। যে কারণে এ উপায়ে নিয়মিত হচ্ছে খুব সামান্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ছিল ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। সে বিবেচনায় এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন লাখ ৫৯ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা। এর মানে এক বছরে খেলাপি বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। আর গতবছরের ডিসেম্বরে ছিল তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। এর মানে ৯ মাসে বেড়েছে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় খেলাপি ঋণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। শুরুর দিকে আন্তর্জাতিক রীতিনীতির আলোকে ব্যাংক খাত পরিচালিত হচ্ছিল। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতপশিল ব্যবস্থা চালু হয়। এর পর থেকে নানা শিথিলতায় খেলাপি ঋণ কম দেখানো হচ্ছিল। এক্ষেত্রে কখনো ঋণ পরিশোধ না করই নিয়মিত রাখা, নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে পুনঃতপশিল কিংবা ভুয়া ঋণ নিয়ে দায় সমন্বয়ের সুযোগ দেওয়া হতো।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর গত বছরের আগস্টে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ব্যাংক খাতের অনৈতিক চর্চার বিরুদ্ধে কঠোরতা দেখিয়ে আসছেন। কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রেখে এবার লভ্যাংশ দিতে দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী বছর কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের বেশি হলে যত মুনাফাই হোক, লভ্যাংশ দিতে পারবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক বছরে একবার দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের তথ্য প্রকাশ করে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২০২৪ সালে এই ঋণ বেড়ে ৭ লাখ ৫৭ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা হয়েছে, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৪৪.২৬ শতাংশ। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৯৭ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। এক বছরে খারাপ ঋণ ২ লাখ ৫৯ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা বা ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্দশাগ্রস্ত ঋণের মধ্যে পুনঃতপশিল করা অনাদায়ী ঋণ রয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা, নিয়মিত খেলাপি হিসেবে দেখানো ঋণ ৩ লাখ ৪৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। এছাড়া অবলোপন করা অনাদায়ী ঋণ ২০২৪ সালে বেড়ে ৬২ হাজার ৩২৭ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। আগে পুনঃতপশিলসহ বিভিন্ন কৌশলে নিয়মিত দেখানো ঋণ এখন মূলত খেলাপি হয়ে উঠছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



