ছবি: সংগৃহীত
দেশের কর প্রশাসন ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের এক গুরুত্বপূর্ণ শূন্যতা পূরণ হলো তিনটি প্রধান রাজস্ব আইনের অফিসিয়াল ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সরকারি গেজেটে ‘অথেনটিক ইংলিশ টেক্সট’ নামে পরিচিত এসব আইনের ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ করেছে। এর ফলে বিনিয়োগ, কর প্রশাসন, গবেষণা ও ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটি বড় অগ্রগতি ঘটবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কী কী আইন প্রকাশ হলো
সরকারি গেজেটে প্রকাশিত তিনটি আইন হলো—
-
মূল্য সংযোজন কর আইন, ২০১২ (VAT Act, 2012)
-
কাস্টমস আইন, ২০২৩ (Customs Act, 2023)
-
আয়কর আইন, ২০২৩ (Income Tax Act, 2023)
এই তিন আইনই দেশের রাজস্ব সংগ্রহের মূল স্তম্ভ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু তাদের নির্ভুল ও স্বীকৃত ইংরেজি অনুবাদ না থাকায় দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারী, গবেষক, আইনজীবী, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এবং বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগীরা বহু বছর ধরে নানা জটিলতা ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ছিলেন। এনবিআরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আল আমিন শেখ এসব তথ্য নিশ্চিত করেন।
ইংরেজি সংস্করণের প্রয়োজন কেন ছিল
বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কোনো দেশের কর আইন যদি ইংরেজি ভাষায় প্রামাণিকভাবে প্রকাশিত না থাকে, তবে তা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। Bangladesh-এ বিদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়লেও তাদের বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক পরামর্শক দল ইংরেজিতে দক্ষ। বাংলা ভাষায় প্রণীত আইনের অনুবাদ আলাদাভাবে সংগ্রহ করে কাজ করতে গিয়ে অনেক ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হত।
এছাড়া গবেষণা, নীতিমালা বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তি, উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্প প্রস্তুতি—সব ক্ষেত্রেই ইংরেজি টেক্সট অত্যাবশ্যক। দীর্ঘদিন ধরে আইনজীবী, ট্যাক্স কনসালট্যান্ট, ব্যবসায়ী ফোরাম এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী গোষ্ঠীগুলো বারবার দাবি জানিয়ে আসছিলেন আইনের অথেনটিক ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশের জন্য।
আইনের সংস্করণ তৈরির দীর্ঘ প্রক্রিয়া
এনবিআর জানায়, নতুন আইন প্রণয়নের পরই ইংরেজি সংস্করণ তৈরির কাজ শুরু হয়। ২০২৩ সালে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ ও কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯ বাতিল করে প্রণীত হয় নতুন আয়কর আইন ও কাস্টমস আইন। এর পরে আইনগুলোর ইংরেজি টেক্সট প্রস্তুত করার জন্য এনবিআরের আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের দক্ষ কর্মকর্তারা বহু মাস ধরে কঠোর পরিশ্রম করেন।
প্রক্রিয়াটি ছিল কয়েক ধাপে বিভক্ত—
-
প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত – আইনি ভাষা, ধারা, উপধারার প্রযুক্তিগত ব্যাখ্যা এবং আন্তর্জাতিক মান অনুসারে শব্দচয়ন ঠিক করা।
-
রিভিউ কমিটির পর্যবেক্ষণ – পৃথক কমিটি একাধিক দফায় লাইন-বাই-লাইন পর্যালোচনা করে অসংগতি, অস্পষ্টতা বা দ্ব্যর্থতা চিহ্নিত করে।
-
আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং – চূড়ান্ত খসড়া পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ শাখায়। তারা পেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংশোধন এনে আইনগতভাবে সঠিক ও আন্তর্জাতিক মানের উপযোগী টেক্সট অনুমোদন করে।
-
বিজি প্রেসে মুদ্রণ – অনুমোদনের পর বিজি প্রেসে মুদ্রণ হয় এবং পরে সরকারি গেজেটে অফিসিয়ালি প্রকাশ করা হয়।
এই প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ হলেও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ ভুল অনুবাদ বা অস্পষ্ট ব্যাখ্যা ভবিষ্যতে কর-সংক্রান্ত মামলায় বড় ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারত।
বিনিয়োগ ও অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব
এনবিআর মনে করে, তিন রাজস্ব আইনের প্রামাণ্য ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশের ফলে বিনিয়োগ পরিবেশে একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে। করদাতাদের আইনের প্রতি আস্থা বাড়বে, ব্যবসা সহজীকরণ প্রক্রিয়া আরও শক্তিশালী হবে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্বচ্ছভাবে আইন বুঝে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন—
-
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর Compliance কাজ সহজ হবে।
-
আন্তর্জাতিক পরামর্শক ও অডিট প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দ্রুত নীতিগত পরামর্শ দিতে পারবে।
-
ট্যাক্স ট্রাইবুনাল, আদালত ও রেগুলেটরি সংস্থাগুলো আইন প্রয়োগে আরও নির্ভুলভাবে কাজ করতে পারবে।
-
ভবিষ্যতে WTO, ADB, World Bank বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা দেশের রাজস্ব ও বাণিজ্য নীতিমালা মূল্যায়নে একক ইংরেজি টেক্সট অনুসরণ করতে পারবে।
সব মিলিয়ে এটি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আধুনিকায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে মনে করছেন নীতি–বিশ্লেষকেরা।
করদাতাদের জন্য কী বদলাবে
করদাতাদের জন্য আইন বোঝা ও মেনে চলা আরও সহজ হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদের ওপর নির্ভর না করে সরাসরি অফিসিয়াল ইংরেজি টেক্সট ব্যবহার করে কর হিসাব ও প্রস্তুতি করতে পারবে। এতে—
-
আইন ব্যাখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি কমবে
-
বিভিন্ন পরামর্শকের দেওয়া আলাদা আলাদা অনুবাদের ঝুঁকি দূর হবে
-
মামলাজট কমতে সহায়তা করবে
-
আইন প্রয়োগে ভুল ব্যাখ্যার সম্ভাবনা কমে যাবে
তিনটি রাজস্ব আইনের অফিসিয়াল ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশ বাংলাদেশকে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কাঠামোর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি শুধু বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণই সহজ করবে না, বরং দেশের কর প্রশাসনকে আধুনিক, স্বচ্ছ ও বিনিয়োগবান্ধব করার দিকেও বড় ভূমিকা রাখবে। এনবিআরের দীর্ঘ প্রস্তুতি ও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই প্রকাশনা রাজস্ব ব্যবস্থায় নতুন আস্থা ও গতি সঞ্চার করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



