ছবি: সংগৃহীত
নির্বাচনী সমঝোতার পথে দ্রুত এগোচ্ছে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দল দুটির মধ্যে একাধিক দফা বৈঠক ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে এবং ২৯ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগেই আসন সমঝোতা বা জোট সংক্রান্ত কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। তবে জামায়াত–এনসিপির এই ঘনিষ্ঠতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আট দলীয় জোটে দেখা দিয়েছে তীব্র টানাপোড়েন, অসন্তোষ ও ভাঙনের আশঙ্কা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার রাতে দুই দফা এবং বৃহস্পতিবার এক দফা বৈঠক হয়েছে জামায়াত ও এনসিপির শীর্ষ নেতাদের মধ্যে। এসব বৈঠকে নির্বাচনী কৌশল, আসন বণ্টন এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমন্বয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হয়নি।
তবে এনসিপির ভেতরেই জামায়াতের সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতা নিয়ে মতভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে সদ্য পদত্যাগ করা দুই ছাত্র উপদেষ্টা ও তাঁদের অনুসারীরা এই সমঝোতার ঘোর বিরোধী। তাঁদের একটি অংশ মনে করছে, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে জোট এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান ও ভবিষ্যৎ গ্রহণযোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তারা বরং বিএনপির সঙ্গে জোট বা নির্বাচনী বোঝাপড়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে জামায়াত ও এনসিপির আলোচনা চলার মধ্যেই আট দলীয় জোটে ক্ষোভ জমতে শুরু করেছে। জামায়াতের দীর্ঘদিনের মিত্র চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস প্রত্যাশিত সংখ্যক আসন না পাওয়ায় প্রকাশ্যেই অসন্তোষ জানাচ্ছে। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী, জামায়াত ১৩৫ আসনে, এনসিপি নেতৃত্বাধীন জোট ৩০ আসনে এবং বাকি সাত দল মিলিয়ে ১৩৫ আসনে নির্বাচন করবে। কিন্তু এই প্রস্তাবে জামায়াত রাজি নয় বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
সূত্রগুলোর ভাষ্য, জামায়াত এককভাবে দুই শতাধিক আসনে প্রার্থী দিতে চায়। এনসিপি ও এবি পার্টিকে সর্বোচ্চ ৩০টি আসন ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। বাকি আসন ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত আন্দোলন, জাগপা ও বিডিপির মধ্যে বণ্টনের পরিকল্পনা রয়েছে। এই হিসাবেই শুরু হয়েছে জোটের ভেতরের টানাপোড়েন।
এনসিপির সঙ্গে যুক্ত এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মিলে গঠিত গণতান্ত্রিক সংস্কার জোটও আসন বণ্টন নিয়ে দ্বিধায় রয়েছে। এনসিপি ও এবি পার্টির জোট ৫০টি আসন দাবি করলেও এবি পার্টি এককভাবে অন্তত ১৫টি আসনে নির্বাচন করতে চায়। তবে এনসিপির একটি অংশ মনে করছে, এবি পার্টিকে এত আসন ছাড় দিলে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হবে।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জানিয়েছেন, জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা এখনো চলমান। জোট বা আসন সমঝোতা হলে তা আনুষ্ঠানিকভাবেই জানানো হবে।
জামায়াত ও এনসিপি সূত্র জানায়, বুধবার সন্ধ্যায় জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের সঙ্গে বৈঠক করেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। পরে রাজধানীর বাংলামটরে এনসিপির কার্যালয়ে নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়ে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই রাতেই জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বাসায় নাহিদ ইসলাম, এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেনসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা বৈঠকে বসেন।
গত মাসে এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন একসঙ্গে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট গঠন করলেও জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনা শুরু হওয়ার পর রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন কার্যত জোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। তবে এনসিপি ও এবি পার্টি যৌথভাবে জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। দুই দল মিলেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করছে, যা খুব শিগগিরই জামায়াতের কাছে হস্তান্তরের কথা রয়েছে। এবি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ভূঁইয়া ফুয়াদ জানিয়েছেন, আগে নিজেদের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হচ্ছে, এরপর আসন বণ্টন নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা হবে।
এই পরিস্থিতিতে সাবেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার অনুসারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তারা মনে করছেন, জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে জোট অভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সরকার থেকে ১৫ দিন আগে পদত্যাগ করলেও মাহফুজ ও আসিফ এখনো কোনো দলে যোগ দেননি। আসিফ মাহমুদ ইতোমধ্যে ঢাকা-১০ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, আর মাহফুজ আলম এ বিষয়ে নীরব রয়েছেন।
জামায়াতের সঙ্গে জোটের গুঞ্জনের পর আসিফ মাহমুদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত ছাত্রনেতা আবদুল কাদের ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি রিফাত রশিদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানান। তারা জামায়াতের সঙ্গে জোটের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। এ অবস্থায় বিএনপির সঙ্গে জোটের দাবিতে এনসিপি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব মীর আরশাদুল হক।
এনসিপি সূত্র জানায়, সাবেক দুই উপদেষ্টা ও তাদের সমর্থকদের একটি বড় অংশ বিএনপির সঙ্গে জোটের পক্ষে থাকলেও আসন বণ্টন নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্ব বিএনপির পথ থেকে সরে এসেছে। গত মাসে বিএনপি সাত-আটটি আসন ছাড়ার প্রস্তাব দিলেও শেষ মুহূর্তে তা কমিয়ে চারটিতে নামিয়ে আনে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে এনসিপির একটি অংশ জামায়াতের সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
অন্যদিকে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন ও মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ক্ষোভ ক্রমেই প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন শুরুতে ১৫০ আসন দাবি করলেও পরে তা কমিয়ে ১২০ এবং সর্বশেষ ১০০ আসনে নেমে আসে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস প্রথমে ৫০ আসন চেয়েছিল, পরে ৩৫ এবং এনসিপি জোটে এলে অন্তত ২২টি আসনের দাবি তোলে। কিন্তু জামায়াত এসব দলকে যথাক্রমে ৩০–৩৫ এবং ১০–১২টির বেশি আসন দিতে রাজি নয় বলে জানা গেছে।
এ অবস্থায় গতকাল গুঞ্জন ছড়ায়, ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস জোট ছাড়তে পারে। তবে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম সচিব আতাউল্লাহ আমিন এই গুঞ্জন নাকচ করে বলেছেন, আসন বণ্টনের আলোচনা এখনো চলমান।
দলীয় সূত্র জানায়, আগামী রোববার আট দলের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে জামায়াত। তবে ইসলামী আন্দোলন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস স্পষ্ট করে জানিয়েছে, আসন বণ্টনের বিষয়ে সন্তোষজনক সমাধান না হলে তারা ওই বৈঠকে যোগ দেবে না। এদিকে শরিফ ওসমান হাদি হত্যার বিচারসহ তিন দাবিতে ৩ জানুয়ারি ঢাকায় মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে জামায়াত। এতে সব দলের থাকার কথা থাকলেও ইসলামী আন্দোলন জানিয়েছে, তারা একই দাবিতে ৯ জানুয়ারি আলাদা সমাবেশ করবে।
আট দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ জানিয়েছেন, আসন বণ্টন নিয়ে আলোচনা শেষ পর্যায়ে। দু-এক দিনের মধ্যেই সব জট খুলে যাবে। তাঁর দাবি, সংস্কারের পক্ষে থাকা সব দল একসঙ্গেই নির্বাচনে যাবে এবং জোট ভাঙার আশঙ্কা নেই।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াত–এনসিপির ঘনিষ্ঠতা যেমন নতুন সমীকরণ তৈরি করছে, তেমনি আট দলীয় জোটের ভেতরে পুরোনো ভারসাম্য ভেঙে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কারা একসঙ্গে থাকবে আর কারা আলাদা পথে হাঁটবে—তা নির্ভর করবে আসন বণ্টনের শেষ সিদ্ধান্তের ওপরই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



