ছবি: সংগৃহীত
চলতি ২০২৫–২৬ করবর্ষ থেকে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের জন্য অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কর ব্যবস্থাকে আধুনিক, স্বচ্ছ ও হয়রানিমুক্ত করার লক্ষ্যে নেওয়া এই উদ্যোগ ইতোমধ্যে করদাতাদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর প্রযুক্তি সেবা বাস্তবায়নের পেছনে একটি গুরুতর প্রশাসনিক ও আইনি প্রশ্ন সামনে এসেছে—এনবিআরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সিনেসিস আইটির কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তি নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের লাখ লাখ করদাতার ব্যক্তিগত ও আর্থিক তথ্য জড়িত এমন একটি ব্যবস্থায় চুক্তি ছাড়া সেবা গ্রহণ তথ্যের নিরাপত্তা, দায়বদ্ধতা এবং ভবিষ্যৎ আইনি জটিলতার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে এনবিআরের ভেতরেও নীরব উদ্বেগ রয়েছে।
বর্তমানে অনলাইন পদ্ধতিতে করদাতারা ঘরে বসেই আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন। এতে কর কার্যালয়ে গিয়ে হয়রানি, দালালচক্রের দৌরাত্ম্য ও ঘুসবাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। দীর্ঘদিন ধরে ব্যক্তি শ্রেণির করদাতারা যে ভোগান্তির শিকার হচ্ছিলেন, তা অনেকাংশে দূর হওয়ায় এনবিআরের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সাধারণ করদাতারা। গত ৪ জুলাই অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আনুষ্ঠানিকভাবে অনলাইন আয়কর রিটার্ন দাখিল কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
কিন্তু এর আড়ালে চুক্তিহীনভাবে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই সেবা চালু থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনুদানে সিনেসিস আইটি অনলাইন রিটার্ন দাখিলের সফটওয়্যারটি তৈরি করে। ২০২১ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এই সেবার জন্য ইইউ সিনেসিস আইটিকে নিয়মিত সার্ভিস চার্জ প্রদান করে এসেছে।
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইইউ তাদের অর্থায়ন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় এবং একই সঙ্গে এনবিআর ও সিনেসিস আইটিকে সরাসরি একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য একাধিকবার তাগাদা দেয়। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার পরও চুক্তি না হওয়ায় ইইউ নিজ উদ্যোগে ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বাড়ায়। তবে এই বাড়তি সময়ের জন্য কোনো আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে না—এমন শর্তও আরোপ করা হয়।
এরপর প্রায় এক বছর পার হয়ে গেলেও এনবিআর ও সিনেসিস আইটির মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি হয়নি। এই সময়ের মধ্যেই এনবিআর অনলাইন আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক ঘোষণা করেছে, যা দেশের লাখো করদাতার জন্য প্রযোজ্য।
চুক্তির বিষয়টি স্বীকার করে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, সিনেসিস আইটির সঙ্গে চুক্তি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সরকারি ক্রয়বিধি অনুযায়ী টেন্ডার, যাচাই-বাছাই এবং প্রশাসনিক অনুমোদনের একাধিক ধাপ অনুসরণ করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ। এ জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং তারা কাজ করছে।
চুক্তি ছাড়া সেবা গ্রহণে তথ্যের নিরাপত্তা বা আইনি ঝুঁকি তৈরি হতে পারে—এমন আশঙ্কার বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, তিনি আপাতত এ ধরনের কোনো বড় সমস্যা দেখছেন না। তাঁর মতে, সিনেসিস আইটি একটি দেশীয় ও দায়িত্বশীল প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি এনবিআরের নিজস্ব জনবল ব্যাকএন্ডে তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, চুক্তি সম্পন্ন হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।
অন্যদিকে সিনেসিস আইটির পক্ষ থেকেও চুক্তিহীনভাবে সেবা দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির চিফ সলিউশনস অফিসার আমিনুল বারি শুভ্র বলেন, তারা একাধিকবার চুক্তির জন্য এনবিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘ প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার কারণে বিষয়টি ঝুলে আছে। চুক্তি না থাকায় প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লেও করদাতাদের তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেই বলে তিনি দাবি করেন।
সিনেসিস আইটির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রায় এক বছর ধরে তারা এনবিআরকে গুরুত্বপূর্ণ এই সেবা দিয়ে আসছেন। কিন্তু কোনো চুক্তি না থাকায় এখনো একটি টাকাও বিল হিসেবে পাননি। অথচ সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণ, সাইবার নিরাপত্তা এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনায় তাদের নিজস্ব জনবল নিয়োজিত রয়েছে, যাদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, কোনো ধরনের পারিশ্রমিক ছাড়া দীর্ঘদিন সেবা দেওয়া একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত কঠিন। তারপরও দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা প্রমাণ এবং জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় তারা অনলাইন আয়কর রিটার্ন দাখিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেবাটি চালু রেখেছেন। তবে এভাবে দীর্ঘদিন চালিয়ে গেলে কোম্পানির আর্থিক ‘রক্তক্ষরণ’ আরও বাড়বে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে এনবিআরের ভেতরের কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের সব করদাতার জন্য বাধ্যতামূলক করা একটি সেবার কোনো চুক্তি না থাকা সত্যিই উদ্বেগজনক। ভবিষ্যতে যদি কোনো আইনি বিরোধ, তথ্য ফাঁস বা সেবায় বিঘ্ন ঘটে, তাহলে দায় কার—সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এ বিষয়ে এনবিআরের সদস্য (কর তথ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবা) আবু হান্নান দেলওয়ার হোসেন বলেন, চুক্তির বিষয়টি প্রকিউরমেন্ট ও বোর্ড প্রশাসনের আওতাভুক্ত। এই প্রক্রিয়ায় তাঁর সরাসরি কোনো ভূমিকা নেই এবং বিষয়টি সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত জানেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর ব্যবস্থার ডিজিটাল রূপান্তর নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এমন একটি সংবেদনশীল তথ্যভিত্তিক সেবায় চুক্তি, দায়বদ্ধতা ও আইনি কাঠামো স্পষ্ট না থাকলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে। তাই করদাতাদের স্বার্থ, রাষ্ট্রীয় তথ্যের নিরাপত্তা এবং সেবা ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে দ্রুত একটি স্বচ্ছ ও শক্তিশালী চুক্তিতে পৌঁছানো জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



