ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে টিকিট জালিয়াতি, ভুয়া তথ্য ব্যবহার এবং আর্থিক অনিয়মে জড়িত ১০টি সংঘবদ্ধ চক্র শনাক্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। বিমানের নিজস্ব তদন্তে উঠে এসেছে, যাত্রীদের নামে ভুয়া বা বিকৃত তথ্য ব্যবহার করে টিকিট ইস্যু করা, একাধিক হাতবদলের মাধ্যমে টিকিট সরবরাহ এবং নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিল। এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে বিমান কর্তৃপক্ষ।
বিমান সূত্র জানায়, তদন্তে কারসাজি চক্রের মূলহোতা হিসেবে বন ভয়েজ ট্রাভেলস অ্যান্ড ওভারসিজকে চিহ্নিত করা হয়েছে। পাশাপাশি তাদের সহযোগী সাব-এজেন্ট, ঢাকার বাইরে গাইবান্ধাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান এবং ইডেন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস ও ক্রিয়েটিভ ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের সঙ্গে বিমানের সব ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনো টিকিট ইস্যু বা বাণিজ্যিক লেনদেন না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের রাজস্ব শাখার ডেপুটি ম্যানেজার সাজ্জাদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ২৩ ডিসেম্বরের এক চিঠিতে জানানো হয়, রেভিনিউ ইন্টিগ্রিটি ও আইবিই রেভিনিউ শাখার নিয়মিত মনিটরিং কার্যক্রমের সময় কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্টের টিকিট ইস্যু ও পেমেন্ট প্যাটার্নে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে। প্রাথমিকভাবে বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হওয়ায় বিমান কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করে, যারা টিকিট ইস্যু প্রক্রিয়া, যাত্রী তথ্য, পেমেন্ট রেকর্ড ও এজেন্টদের কার্যক্রম খতিয়ে দেখে।
তদন্তে দেখা গেছে, কিছু ট্রাভেল এজেন্ট বিমানের আইটি সিস্টেমের সীমাবদ্ধতা ও নীতিগত দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে অননুমোদিতভাবে টিকিট ইস্যু করছিল। এই জালিয়াতিতে একাধিক এজেন্সি ও ব্যক্তির মধ্যে সমন্বয় ছিল, যাতে প্রকৃত ঘটনা আড়াল থাকে এবং দায় এড়ানো যায়। কোথাও কোথাও একটি টিকিট চূড়ান্ত ইস্যুর আগে তিন থেকে চারবার হাতবদল হয়েছে, ফলে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২৩ ডিসেম্বর বিমানের উচ্চপর্যায়ের এক সভায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের আইএটিএ আইডি ও ইনভেন্টরি অ্যাক্সেস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এই চক্রগুলোর সঙ্গে বিমানের সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে চারটি ট্রাভেল এজেন্সি ও ছয় ব্যক্তিসহ একটি সংগঠিত চক্রকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা হয়েছে। এই চক্রে রাজধানী ও জেলা পর্যায়ের ট্রাভেল এজেন্সি, স্থানীয় পর্যায়ে জনশক্তি এজেন্ট পরিচয়ে যাত্রী সংগ্রহকারী ব্যক্তি এবং টেকনিক্যাল ও লজিস্টিক সহায়তাকারীরা জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। তদন্তকারীরা বলছেন, এই সমন্বিত কাঠামোর কারণেই দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াতি ধরা পড়েনি।
বিমানের রেভিনিউ বিভাগ জানিয়েছে, এ ধরনের অনিয়ম শুধু আর্থিক ক্ষতির কারণ নয়, বরং আন্তর্জাতিক মান ও আইএটিএ নীতিমালার সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। এতে বিমানের সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক রুটে পরিচালনায় জটিলতা তৈরি হতে পারে। তাই ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির আওতায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন (অব.) এম. ফারুক হোসেন বলেন, “এয়ারলাইন্স শিল্পে টিকিটিং সিস্টেম অত্যন্ত সংবেদনশীল। এখানে সামান্য দুর্বলতাও বড় ধরনের জালিয়াতির সুযোগ তৈরি করে। বিমানের উচিত আধুনিক রিস্ক অ্যানালিটিক্স ও রিয়েল-টাইম মনিটরিং ব্যবস্থা আরও জোরদার করা।”
অন্যদিকে ভোক্তা অধিকার বিশ্লেষক অধ্যাপক রাশেদ মাহমুদ বলেন, “এই ধরনের জালিয়াতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ যাত্রীরা। টিকিটের দাম বেড়ে যায়, ভ্রমণ অনিশ্চিত হয়। শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা নয়, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে।”
আইটি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিমানের টিকিটিং ও পেমেন্ট সিস্টেমে নিয়মিত অডিট, মাল্টি-লেয়ার অথেন্টিকেশন এবং এজেন্ট অ্যাক্টিভিটির ওপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নজরদারি চালু করা জরুরি। এতে ভবিষ্যতে এমন জালিয়াতি দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব হবে।
বিমান সূত্র জানায়, প্রাথমিক মূল্যায়নে ধারণা করা হচ্ছে, সময়মতো এই জালিয়াতি শনাক্ত না হলে সংস্থাটি বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকির মুখে পড়তে পারত। ইতোমধ্যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলা করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি এই চক্রের সঙ্গে বিমানের ভেতরের কেউ জড়িত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চতর তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই তদন্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধাচার নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে এটি অন্যান্য ট্রাভেল এজেন্টদের জন্যও একটি সতর্ক বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



