ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ববাজারে হস্তশিল্প পণ্যের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। পরিবেশবান্ধব, হাতে তৈরি ও ঐতিহ্যনির্ভর পণ্যের প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহের কারণে এই খাত এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সঠিক নীতি সহায়তা, অর্থায়ন ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশেও হস্তশিল্প রপ্তানি খাত সহজেই বিলিয়ন ডলারের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বে হস্তশিল্প পণ্যের মোট বাজারের আকার এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এই বিশাল বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ এখনো খুবই সীমিত। বাংলাদেশ থেকে হস্তশিল্প খাতে বার্ষিক রপ্তানি মাত্র ৩৮০ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৩৮ কোটি ডলারের মতো। অর্থাৎ বৈশ্বিক বাজারের মাত্র ১ দশমিক ১৮ শতাংশ পণ্যই বাংলাদেশ রপ্তানি করতে পারছে।
এই বাস্তবতা তুলে ধরে বুধবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট (সিইডি) যৌথভাবে একটি সেমিনারের আয়োজন করে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে আয়োজিত ওই সেমিনারে হস্তশিল্প খাতের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও নীতিগত করণীয় নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ। সভাপতিত্ব করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক আরশাদ মাহমুদ চৌধুরী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইপিবির পরিচালক আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেন। এছাড়া খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা, গবেষক, নীতিনির্ধারক ও বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ আলোচনায় অংশ নেন।
মূল প্রবন্ধে জানানো হয়, বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে পাটজাত কার্পেট, ধাতব হস্তশিল্প, পাথরের তৈরি পণ্য এবং বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন সামগ্রী মূলত রপ্তানি হচ্ছে। এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার থাকলেও উৎপাদন সক্ষমতা, মান নিয়ন্ত্রণ, আধুনিক নকশা ও বিপণন কাঠামোর দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ তার সম্ভাবনার পুরোটা কাজে লাগাতে পারছে না।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাসান আরিফ বলেন, উদ্যোক্তা হতে হলে সমস্যার মধ্য দিয়েই এগোতে হয়। হস্তশিল্প খাতেও নানা প্রতিবন্ধকতা আছে, কিন্তু সেগুলো জয় করেই সামনে যেতে হবে। তিনি জানান, আগে হস্তশিল্প রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হতো। তবে বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এ ধরনের উচ্চ প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব হবে না। সে কারণে প্রণোদনা কমিয়ে ৬ শতাংশে নামানো হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, প্রণোদনা কাঠামো নিয়ে এখনো আরও সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে।
বিদেশি মেলায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ভিয়েতনাম, চীন বা ভারতের উদ্যোক্তারা খুব একটা সরকারি সহায়তায় বিদেশি মেলায় যান না। বরং তারা নিজেদের প্রস্তুতি ও নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভর করেন। তাই বাংলাদেশেও বিদেশি ক্রেতাদের দেশে এনে সোর্সিং ফেয়ার আয়োজনের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের মেলায় যাওয়ার আগে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে। উদ্যোক্তা ও বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি যোগাযোগ বজায় রাখতে একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরির কথাও জানান তিনি।
মূল প্রবন্ধে আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেন বলেন, যথাযথ নীতিগত সহায়তা পেলে হস্তশিল্প খাত থেকে বছরে এক বিলিয়ন ডলার বা ১০০ কোটি ডলারের বেশি রপ্তানি অর্জন করা সম্ভব। এর জন্য সবচেয়ে জরুরি দুটি বিষয় হলো—বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা এবং সহজ অর্থায়ন। কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদন খরচ কমাতে বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা না থাকায় উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী পরিবেশবান্ধব পণ্যের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩২ সালের মধ্যে বৈশ্বিক হস্তশিল্প বাজারের আকার দুই ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই বিশাল বাজার ধরতে হলে বাংলাদেশকে পণ্যের মান, নকশা ও উৎপাদন সক্ষমতায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে।
চীন ও ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি। পাশাপাশি আধুনিক ডিজাইন, নতুন রঙ ও ফিনিশিং, আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার তাগিদ দেন। তাঁর মতে, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয় ঘটাতে পারলেই বাংলাদেশি হস্তশিল্প পণ্য বৈশ্বিক বাজারে আলাদা পরিচিতি পাবে।
বাংলাদেশ হস্তশিল্প প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বাংলাক্রাফট)-এর সভাপতি বেলাল হোসেন বলেন, এই খাতে উদ্যোক্তার সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। অনেকের ভালো পণ্য ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তারা সামনে এগোতে পারছেন না, কারণ আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যোগাযোগের ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে অনলাইনে সক্রিয় থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডিজিটাল মার্কেটিং ও ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে উপস্থিতি না থাকলে টিকে থাকা কঠিন হবে।
তিনি আরও বলেন, হস্তশিল্প খাত টিকিয়ে রাখতে আগের মতো ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা পুনর্বহাল করা জরুরি। এলডিসি উত্তরণের পর প্রণোদনা কমলেও বিকল্প সহায়তা না দিলে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা বড় ঝুঁকিতে পড়বেন বলে তিনি সতর্ক করেন।
সেমিনারে অংশ নেওয়া অর্থনীতিবিদ ও শিল্প বিশেষজ্ঞরা বলেন, হস্তশিল্প খাত শুধু রপ্তানি আয় নয়, গ্রামীণ কর্মসংস্থান, নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টি এবং সংস্কৃতি সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে গ্রামভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের এই খাতে যুক্ত করা গেলে দারিদ্র্য হ্রাসেও বড় অবদান রাখা সম্ভব।
তারা মনে করেন, নীতি সহায়তা, অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও বাজার সংযোগ—এই চারটি বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া গেলে বাংলাদেশের হস্তশিল্প খাত আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি সম্ভাবনায় রূপ নিতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ
.png)
.png)
.png)



