
ছবি: সংগৃহীত
ভারত সরকার বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ বেশ কিছু পণ্যের স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এই পদক্ষেপ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক উত্তেজনাকে আরও জটিল করে তুলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গত শনিবার ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (DGFT) থেকে পাঠানো এক নির্দেশনায় এ সিদ্ধান্ত জানানো হয়, যা টাইমস অব ইন্ডিয়াসহ ভারতের জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের জারি করা নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এখন থেকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শুধুমাত্র কলকাতা ও নভি মুম্বাইয়ের জওহরলাল নেহরু পোর্ট (নভসেবা) সমুদ্রবন্দর দিয়ে ভারতের বাজারে প্রবেশ করতে পারবে। অন্য যেকোনো স্থলবন্দর—বিশেষত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত সীমান্ত বন্দরগুলো দিয়ে আর পোশাক আমদানি সম্ভব হবে না। এই বিধিনিষেধের ফলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প—যেটি দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ জোগান দেয়—বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
নতুন এই বিধিনিষেধ যুক্ত হয়েছে ভারতের আমদানি নীতিমালার ‘আইটিসি (এইচএস) ২০২২’ এর সিডিউল ১ এর অধীনে। এতে বলা হয়, দেশের নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ বাজারের সুরক্ষার স্বার্থে নির্দিষ্ট কিছু পণ্য এখন থেকে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট বন্দরের মাধ্যমে আমদানি করা যাবে। এর অংশ হিসেবেই পোশাকসহ অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে।
ভারতের এই পদক্ষেপ একতরফাভাবে নেওয়া হয়নি বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকরা। কারণ, এক মাস আগেই বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভারত থেকে বেনাপোল, ভোমরা, সোনামসজিদ, বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে সুতা আমদানির সুযোগ বন্ধ করে দেয়। তখন এনবিআর জানিয়েছিল, এই সিদ্ধান্ত দেশের স্থানীয় স্পিনিং শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য নেওয়া হয়েছে।
ভারতের নতুন নির্দেশনায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে আসা বেশ কিছু ভোগ্যপণ্য আর প্রবেশ করতে পারবে না ভারতের আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরার স্থলবন্দর দিয়ে। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি সীমান্তেও একই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। এই নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় রয়েছে—
বিভিন্ন ধরনের কোমল পানীয় ও বেভারেজ
চিপস, কনফেকশনারি, বেকারি সামগ্রী এবং স্ন্যাকস
সুতা ও সুতার বর্জ্য
প্লাস্টিক ও পিভিসি জাতীয় বিভিন্ন সামগ্রী (তবে পিগমেন্ট, ডাইস, প্লাস্টিকাইজার ও গ্রানিউল ব্যতিক্রম)
কাঠ ও কাঠের তৈরি আসবাবপত্র
যদিও বেশকিছু ভোগ্যপণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তবুও বাংলাদেশ থেকে মাছ, এলপিজি গ্যাস, ভোজ্যতেল এবং প্রাকৃতিক পাথর ভারত এখনো আমদানি করছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই পণ্যগুলো ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর জন্য তাৎপর্যপূর্ণ বলেই নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখা হয়েছে।
এর আগে গত ৯ এপ্রিল ভারত বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় দেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছিল। এই সিদ্ধান্তের ফলে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে পণ্য পরিবহন করে ত্রিপুরা কিংবা ভারতের অন্য রাজ্যে প্রবেশের যে সুবিধা বাংলাদেশ দিয়েছিল, তা ভারত আর কাজে লাগাতে পারবে না। এখন তারই প্রতিক্রিয়ায় ভারতও সীমান্ত দিয়ে পণ্যের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেছে বলে ধারণা করছেন অনেকে।
বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের তৈরি পণ্যের ওপর যেমন উচ্চ হারে শুল্ক বসিয়েছে, ভারতের এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য তার চেয়েও কঠিন হতে পারে। কারণ, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশের গার্মেন্টস ও ভোগ্যপণ্যের অন্যতম বড় বাজার। সীমান্তবর্তী এই রাজ্যগুলোর সঙ্গে সড়ক ও স্থলপথে স্বল্প খরচে পণ্য রপ্তানি সম্ভব হতো। এখন সে পথ বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বিকল্প ও ব্যয়বহুল পথ বেছে নিতে বাধ্য হবেন।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন ১১টি স্থলবন্দর রয়েছে। এর মধ্যে আসামে ৩টি, মেঘালয়ে ২টি এবং ত্রিপুরায় ৬টি। এই বন্দরগুলোর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বিপুল পরিমাণে পণ্য আদান-প্রদান হতো। একে একে এই বন্দরগুলো বন্ধ হয়ে গেলে তা শুধু দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যই নয়, বরং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের টানাপোড়েন এক নতুন মাত্রায় প্রবেশ করেছে। পোশাক রপ্তানির ওপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা আরোপ দুই দেশের অর্থনীতির ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিকভাবে এই সংকট নিরসনের জন্য কী পদক্ষেপ নেয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ