
ছবি: সংগৃহীত
রাজনীতিতে তরুণদের সক্রিয় ও অর্থবহ অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারণে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হবে—এমন মন্তব্য করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনীতিতে তরুণদের আরও বেশি করে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। মঙ্গলবার (৬ মে) বিকেলে ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নরওয়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বকারী তরুণদের একটি প্রতিনিধিদল তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা এমন একটি সমাজ গড়তে চাই যেখানে তরুণরা রাজনীতির মূল অংশীদার হবে। সমাজ পরিবর্তনে তরুণদের চিন্তা, উদ্যম ও উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাতে হলে রাজনীতিকে তাদের জন্য উন্মুক্ত, নিরাপদ ও ফলপ্রসূ করতে হবে। তরুণরা যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে না আসে, তাহলে ভবিষ্যতে নেতৃত্বে একটা শূন্যতা তৈরি হবে।”
তিনি আরও বলেন, “তরুণদের কণ্ঠস্বর উপেক্ষিত হলে রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় তারা উপেক্ষিতই থেকে যাবে। এ কারণে রাজনীতির প্রতিটি স্তরে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।”
সাক্ষাতে উপস্থিত ছিলেন নরওয়ের সাতটি প্রধান রাজনৈতিক দলের তরুণ প্রতিনিধিরা। এরা হলেন: সোশ্যালিস্ট ইয়ুথ লীগের ডেপুটি লিডার নাজমা আহমেদ, ওয়ার্কার্স ইয়ুথ ফেডারেশনের (AUF) আন্তর্জাতিক নেতা ফাউজি ওয়ারসামে, সেন্টার পার্টির প্রতিনিধি ডেন স্কফটেরুড, কনজারভেটিভ পার্টির সদস্য ওলা স্ভেনেবি, ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটসের সদস্য হ্যাডল রাসমুস বিয়ুল্যান্ড, গ্রিন পার্টির অধিভুক্ত গ্রিন ইয়ুথের সদস্য টোবিয়াস স্টকেল্যান্ড, ইনল্যান্ডেটের ইয়াং লিবারেলসের সাবেক নেতা থাইরা হাকনস্লকেন।
প্রধান উপদেষ্টা তাদের কাছ থেকে তাদের রাজনৈতিক দর্শন, সংগঠনের কাঠামো, সদস্য সংখ্যা, অভিজ্ঞতা ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান।
সাক্ষাৎকালে নরওয়ের প্রতিনিধিরা তাদের বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তারা জানান, এখানে এমন বহু তরুণ রয়েছে যারা এখনো ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি, যা গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী।
তারা প্রধান উপদেষ্টার কাছে জানতে চান—বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কীভাবে এই তরুণদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করছে।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, “গত ১৫ বছর ধরে জনগণ প্রকৃত অর্থে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। টানা তিনটি মেয়াদে এমন একটি প্রহসনের নির্বাচন হয়েছে, যেখানে ভোট ছিল কাগজে কলমে, বাস্তবে নয়। সরকার বলেছে এটি সাফল্য, কিন্তু জনগণ ভোট দিতে পারেনি—এটাই বাস্তবতা।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এখন একটি ট্রানজিশনাল সময় পার করছি। আমাদের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার হচ্ছে—নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত সংস্কার। শুধু প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, কাঠামোগত ও নৈতিক সংস্কার দরকার, যেন ভবিষ্যতে আর কেউ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।”
রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমরা এমন এক ব্যবস্থার উত্তরাধিকার পেয়েছি যেখানে জবাবদিহিতা নেই, তরুণদের অংশগ্রহণ নেই এবং কৃত্রিম নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। এ ধ্বংসস্তূপ থেকে কিছু উপাদান বেছে নিয়ে আমাদের নতুন কাঠামো নির্মাণ করতে হবে। এটিই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন যে এই পরিবর্তনকাল দীর্ঘ হবে না, এবং একটি টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়তে সবাই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই সাক্ষাৎ শুধু কূটনৈতিক সৌজন্যের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত। বর্তমান সরকার কেবল রাজনৈতিক সহিংসতা হ্রাসে নয়, বরং তরুণদের অংশগ্রহণে নতুন এক রাজনৈতিক পরিবেশ গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেই মনে করা হচ্ছে।
রাজনীতিতে তরুণদের অধিকতর সম্পৃক্ততা যে ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য—প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য তারই দৃঢ় প্রতিফলন। আর এ সুযোগ তৈরি করতে হলে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে—যেখানে তরুণদের কণ্ঠস্বর শ্রবণযোগ্য ও প্রভাবশালী হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ