ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ১৮ অক্টোবর যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, সেটি ছিল একদিনের কোনো দুর্ঘটনা নয়; বরং দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা অব্যবস্থাপনা, অবহেলা, দুর্বল তদারকি, অনিয়ম, অগ্নিনিরাপত্তায় গাফিলতি এবং নীতিমালা লঙ্ঘনের এক জটিল সমন্বয়। তদন্ত কমিটির দীর্ঘ ও ব্যাপক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে—বেবিচক (বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ), শেড ইজারাদাতা বাংলাদেশ বিমান, এবং কুরিয়ার এজেন্সিগুলোর সমন্বিত ব্যর্থতাই এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড তো দূরের কথা, জাতীয় নির্মাণ বিধিমালার সর্বনিম্ন নিরাপত্তা নির্দেশনাও তারা মানেনি।
এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি মঙ্গলবার তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়, যা পরে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রেস উইংয়ের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সারসংক্ষেপ আকারে শেয়ার করা হয়। কিন্তু সারসংক্ষেপে যেসব অসংগতি তুলে ধরা হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বিষয়গুলো আরও উদ্বেগজনক এবং বিস্তৃতভাবে উঠে এসেছে।
অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা এবং ত্রুটিপূর্ণ শেড ব্যবস্থাপনা
তদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে—বেবিচক কুরিয়ার শেড ও কার্গো শেড ইজারাদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (BNBC)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। শেডের যে অংশ থেকে আগুনের সূত্রপাত, সেটি অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিতই ছিল না। সেখানে ছিল এলোমেলোভাবে তৈরি একটি বর্ধিত অংশ, যেখানে কুরিয়ার এজেন্সি ডিএইচএল, আরএস ও এসআরকে নিজের মতো করে খাঁচা বানিয়ে মালামাল রাখত—কোনো নিরাপত্তা মান ছাড়াই।
শেডের ভেতরে ছিল অত্যন্ত দাহ্য উপকরণের স্তূপ—পলিথিনে মোড়া কাপড়ের রোল, রাসায়নিক পদার্থ, ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ, বডি স্প্রে ও পারফিউমের বোতল, ব্যাটারি, ওষুধ তৈরির কাঁচামালসহ এমন সব জিনিস যা অগ্নিকাণ্ডকে মুহূর্তে ভয়াবহ আকার দিতে সক্ষম। কোনো সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, ম্যাপিং, লেবেলিং বা সেফটি জোন কিছুই ছিল না। কোথায় কী ধরনের পণ্য রাখা আছে তা কেউই নিশ্চিতভাবে জানতো না।
শেডে থাকা পণ্যের প্রায় ৭৫ শতাংশই ছিল নিলামযোগ্য। অথচ কাস্টমস সেগুলো সময়মতো নিলাম করেনি, নিরাপদ স্থানে সরায়নি, বা ভিন্ন গুদামে স্থানান্তর করেনি। ফলে দাহ্য পণ্যের পাহাড় শেডের ভেতরে আটকে ছিল—যা অগ্নিকাণ্ডের মাত্রাকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
অগ্নিনিরাপত্তার চরম অনিয়ম: কোনো অ্যালার্ম নেই, স্প্রিংকলার নেই, হাইড্রেন্ট নেই
তদন্তে দেখা গেছে, শেডের অফিস ও পণ্য সংরক্ষণ এলাকায় একটিও ফায়ার অ্যালার্ম নেই, একটিও স্মোক ডিটেক্টর নেই, একটি স্প্রিংকলারও নেই, এমনকি ফায়ার হাইড্রেন্ট পর্যন্ত নেই। ফলে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর কেউ তা বুঝতেও পারেনি যতক্ষণ না শেডের ভেতর ঘন ধোঁয়া দেখা যায়।
অগ্নিকাণ্ডের সময় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় ছিল—শেডের সামনে ও অ্যাপ্রোন এলাকায় প্রতিদিনই ৪০০ টনের মতো মালামাল স্তূপ করে রাখা হয়। এ কারণে উত্তরা ফায়ার স্টেশনের গাড়ি দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছায় দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে, এবং তখন শেডের ভেতরকার আগুন প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
আরও ভয়াবহ তথ্য—সমগ্র কার্গো ভিলেজ এলাকায় কোনো স্থায়ী ফায়ার স্টেশনই নেই! বেবিচক ও এফএসসিডির মধ্যে ৯ বছরের পত্রালাপ চললেও এখনো সমঝোতা স্মারক (MoU) সই হয়নি।
তদন্তের মূল অনুসন্ধান: কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত
তদন্ত কমিটি একাধিক সংস্থার সিসিটিভি ফুটেজ, সাইট পরিদর্শন, ফরেনসিক বিশ্লেষণ, সাক্ষ্যগ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়েছে—
আগুনের সূত্রপাত হয়েছে কুরিয়ার শেডের বর্ধিত অংশের উত্তর-পশ্চিম কোণে, যেখানে ডিএইচএল, আরএস এবং এসআরকে কুরিয়ার এজেন্সির খাঁচাগুলো পাশাপাশি ছিল।
প্রায় তিন মাস ধরে বিভিন্ন সংস্থা মিলে বিস্ফোরক, অগ্নিসংযোগ, বৈদ্যুতিক ত্রুটি, রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া বা নাশকতার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে। কিন্তু কোনো বিস্ফোরক, গানপাউডার বা ত্রুটিপূর্ণ তারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল অতিরিক্ত তাপ উৎপন্নকারী দাহ্য পণ্যগুলোর অনিয়ন্ত্রিত মজুত—যা আগুনকে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়।
গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য, ভিডিও ফুটেজ ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত
তদন্ত কমিটি ৯৯ জনের সাক্ষ্য নেয়। এদের মধ্যে ছিলেন—
-
সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা
-
বাংলাদেশ বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিভাগের কর্মকর্তা
-
কাস্টমস কর্মকর্তা
-
কুরিয়ার এজেন্সির প্রতিনিধি
-
শেডের নিরাপত্তাকর্মী
-
ফায়ার সার্ভিস সদস্য
-
মিডিয়া থেকে সংগ্রহ করা প্রত্যক্ষদর্শী ফুটেজ বিশ্লেষক
তুরস্কের AFAD বিশেষজ্ঞ দল, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, সিআইডি ফরেনসিক ল্যাব—সব দল একই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়:
অগ্নিকাণ্ড ছিল দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফল, নাশকতা নয়।
বিমানবন্দরে দীর্ঘদিনের অনিয়ম: ৭টি অগ্নিকাণ্ড, কোনো শিক্ষাই নেয়নি বেবিচক
বেবিচকের তত্ত্বাবধানে ২০১৩ সাল থেকে ইতোমধ্যে ৭টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।
অভিযোগ—প্রতিটি ঘটনার পর কাগুজে তদন্ত কমিটি হলেও বাস্তবে কোনো সংস্কার হয়নি।
কমটি তাদের প্রতিবেদনে বলে—
-
বেবিচকের নিজস্ব অগ্নিনিরাপত্তা সক্ষমতা নেই।
-
প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই।
-
কর্মীরা আধুনিক অগ্নিনিরাপত্তা প্রশিক্ষণ পায় না।
-
ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশ বারবার উপেক্ষা করা হয়।
-
দাহ্য পণ্য আলাদা রাখার সুপারিশ ২০২১ সাল থেকে ঝুলে আছে।
এগুলোই আগুনকে নিভতে না দিয়ে ভয়াবহ আকার নিতে সাহায্য করেছে।
তদন্ত কমিটির গঠন
তদন্ত কমিটি ছিল দেশের অন্যতম শক্তিশালী ও সর্ববৃহৎ যৌথ কমিটি। এতে ছিলেন—
-
তুরস্কের AFAD বিশেষজ্ঞ দল
-
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স
-
সিআইডি ফরেনসিক
-
আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন
-
এনএসআই
-
বিস্ফোরক পরিদপ্তর
-
ডেসকো
-
সিটিটিসি
-
বুয়েট
-
বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী
সবাই মিলে প্রায় দুই মাস ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করে।
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সুপারিশ: বিমানবন্দরের কাঠামো বদলে দিতে পারে
তদন্ত কমিটি বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী সুপারিশ করেছে, যার বাস্তবায়ন হলে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে।
১. বিমানবন্দরের জন্য আলাদা পরিচালনা কর্তৃপক্ষ
বেবিচক এখন থেকে শুধু নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করবে। বিমানবন্দর পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা—সব কিছু পরিচালনা করবে একটি স্বতন্ত্র অপারেটিং অথরিটি।
২. গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং বিমানের বদলে দক্ষ অপারেটরকে দিতে হবে
বাংলাদেশ বিমানের সীমাহীন অদক্ষতা তদন্তে উঠে এসেছে।
তাই তাদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং দায়িত্ব সরিয়ে দক্ষ আন্তর্জাতিক মানের অপারেটরের হাতে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
৩. বিমানবন্দরে বিশেষ শ্রেণির ফায়ার স্টেশন
ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সমন্বয় করে আলাদা হেভি-ডিউটি ফায়ার স্টেশন স্থাপন করতে হবে।
৪. বিপজ্জনক পণ্য আলাদা স্থানে সরানো
রাসায়নিক, পারফিউম, ব্যাটারি, দাহ্য মালামাল—সব অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে।
৫. নিলামযোগ্য পণ্যের আলাদা গুদাম
কাস্টমসকে আলাদা গুদাম করতে হবে যেখানে নিলামযোগ্য পণ্য জমা রাখা হবে।
৬. অ্যাপ্রোন এলাকায় মাল স্তূপ নিষিদ্ধ
ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে না পারায় আগুন ছড়িয়ে পড়ার সময় অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। তাই অ্যাপ্রোন এলাকায় মাল রাখার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ এসেছে।
৭. বিমানবন্দরের জরুরি ফায়ার সেফটি প্ল্যান তৈরি
একটি আন্তর্জাতিক মানের জরুরি প্রস্তুতি পরিকল্পনা তৈরি করা জরুরি।
ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা: আবারও বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি
তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন শেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা দিয়েছে: দুর্বল ব্যবস্থাপনা অব্যাহত থাকলে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ভবিষ্যতেও ঘটতে পারে।
এটি শুধু একটি কার্গো শেডের আগুন নয়— এটি দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার গভীর সংকটের প্রতিফলন।
বাংলাবার্তা/এসজে
.png)
.png)
.png)



