
ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগার ঘটনাটি বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব বিপর্যয় হয়ে উঠেছে। শনিবার দুপুরে শুরু হওয়া এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুধু আমদানি খাতেই নয়, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার সক্ষমতাকেও বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের প্রায় সাত ঘণ্টার নিরলস প্রচেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও, কোটি কোটি টাকার শিল্প কাঁচামাল, রপ্তানির জন্য প্রস্তুত পণ্য এবং জরুরি নথিপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এ ঘটনায় কোনো প্রাণহানির খবর না থাকলেও অন্তত ২৫ জন আনসার সদস্যসহ বহু মানুষ আহত হয়েছেন।
গতকাল শনিবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটসংলগ্ন কার্গো ভিলেজ এলাকায় আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, কুরিয়ার শাখা থেকে আগুনের উৎপত্তি ঘটে, যেখানে বিভিন্ন শিল্প খাতের জন্য আমদানি করা রাসায়নিক, ওষুধের উপকরণ ও স্পর্শকাতর সামগ্রী মজুদ ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একটি এসির কাছ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়, মুহূর্তের মধ্যে বিস্ফোরণের মতো শব্দে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো গোডাউনে। কালো ধোঁয়ার ঘন কুণ্ডলী মুহূর্তে বিমানবন্দরের উত্তরাংশে ছড়িয়ে পড়ে, যা কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যাচ্ছিল।
আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে শাহজালাল বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট ওঠানামা স্থগিত করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। দুপুর সাড়ে ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বিমান ওঠানামা বন্ধ থাকে। এই সময় ঢাকা অভিমুখী অন্তত সাতটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটকে বিকল্প বিমানবন্দরে অবতরণ করানো হয়, যার মধ্যে দুবাই, কুয়ালালামপুর ও মুম্বাই থেকে আসা ফ্লাইট ছিল। সৈয়দপুর, চট্টগ্রাম ও সিলেট রুটের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটগুলোও ব্যাহত হয়। ঢাকাগামী ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট চট্টগ্রামে ফেরত যায়।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, আগুন মূলত কার্গো ভিলেজের আমদানি পণ্য সংরক্ষণ এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে, যাত্রী টার্মিনালে এর কোনো সরাসরি প্রভাব পড়েনি। তবে ধোঁয়া ও নিরাপত্তাজনিত কারণে ফ্লাইট বন্ধ রাখা হয়। রাত ৯টার পর দুবাই থেকে আসা ফ্লাইটটি অবতরণের মাধ্যমে বিমান চলাচল পুনরায় শুরু হয়।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া অফিসার তালহা বিন জসিম জানান, খবর পাওয়ার পর প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে ২টা ৫০ মিনিটে কাজ শুরু করে। একে একে মোট ৩৭টি ইউনিট যুক্ত হয়। বিমানবাহিনীর দুটি ফায়ার ইউনিট, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর সদস্যরাও আগুন নিয়ন্ত্রণে অংশ নেন। আইএসপিআর জানায়, বিজিবির দুই প্লাটুন উদ্ধার অভিযানে সহায়তা করে। ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল নিজে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে অভিযানের তত্ত্বাবধান করেন।
তিনি জানান, প্রবল বাতাসের কারণে আগুন নেভাতে চরম বেগ পেতে হয়। “ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে আমরা চেষ্টা করেছি। বাতাস বারবার আগুন ছড়িয়ে দিচ্ছিল, ফলে এক অংশ নিয়ন্ত্রণে এলেও অন্য অংশে আবার জ্বলে উঠছিল,” বলেন তিনি। আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে রাত ৯টা ১৮ মিনিটে।
রিমোট কন্ট্রোল রোবট ব্যবহার করেও আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হয়, কারণ ভেতরে প্রবেশ করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এ সময় ফায়ার সার্ভিসের দুই কর্মী ও আনসারের কয়েকজন আহত হন।
কার্গো ভিলেজে যেসব পণ্য মজুদ ছিল তার মধ্যে ছিল পোশাক কারখানার কাঁচামাল, ফার্মাসিউটিক্যাল উপকরণ, শিল্প যন্ত্রাংশ, রাসায়নিক দ্রব্য এবং ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “২৫০টিরও বেশি তৈরি পোশাক কারখানার পণ্য পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি। এটি তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ভয়াবহ ধাক্কা।”
ইন্টারন্যাশনাল এয়ার এক্সপ্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি কবীর আহমেদ বলেন, “এই অগ্নিকাণ্ডে বিলিয়ন ডলারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতি হয়েছে। বিমানবন্দর কেপিআইভুক্ত এলাকা, সেখানে আগুন নেভানোর স্থায়ী ব্যবস্থা না থাকা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।”
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) নির্বাহী পরিচালক টি আই এম নুরুল কবীর বলেন, “এখানে অনেক স্পর্শকাতর ও উচ্চমূল্যের পণ্য ছিল—বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আনা ফার্মাসিউটিক্যাল, রাসায়নিক ও ইলেকট্রনিক উপকরণ। এমন সুরক্ষিত এলাকায় এই আগুন ব্যবস্থাপনার মারাত্মক ব্যর্থতা। আমাদের এখনই ডিজিটাল হ্যান্ডলিং ও রিয়েল-টাইম মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।”
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যারা আগুনের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি ও দায় নিরূপণ করে প্রতিবেদন দেবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ পৃথকভাবে পাঁচ সদস্যের দুটি কমিটি গঠন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে, যদি নাশকতার প্রমাণ মেলে, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এভিয়েশন বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “প্রতি দুই বছর অন্তর অগ্নিনিরাপত্তা মহড়া হয়, যেখানে ফায়ার সার্ভিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার দ্রুত সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা যাচাই করা হয়। কিন্তু এই ঘটনায় দেখা গেল, বাস্তব পরিস্থিতিতে সেই সক্ষমতা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।” তিনি আরও বলেন, “শাহজালাল বিমানবন্দর কেপিআইভুক্ত এলাকা—এখানে সাত ঘণ্টা আগুন জ্বলতে থাকা মানে আমরা এখনো বাস্তব জরুরি প্রতিক্রিয়ায় পিছিয়ে।”
প্রত্যক্ষদর্শী ফারুক হোসেন বলেন, “দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে একটি এসির পাশে আগুন দেখি। কয়েক মিনিটের মধ্যে আগুন দাউদাউ করে ছড়িয়ে পড়ে। ড্রামভর্তি রাসায়নিক পুড়তে শুরু করে, একের পর এক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।”
সরেজমিনে দেখা যায়, গোডাউনের ভেতরে আগুনের তীব্রতা এত বেশি ছিল যে, এক পাশে নেভানো মাত্রই অন্যপাশে আবার জ্বলে উঠছিল। বাতাসে ঘন কালো ধোঁয়া, তীব্র তাপ আর দমকলের পানির ছিটা—সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ দৃশ্য।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় রাত ৯টার পর জানায়, “ফায়ার সার্ভিস ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।” মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম জানান, উপদেষ্টা নিজে ঘটনাস্থলে থেকে পরিস্থিতি তদারক করেছেন।
এই অগ্নিকাণ্ড শুধু কোটি টাকার ক্ষতি নয়, বরং দেশের আন্তর্জাতিক বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাও নগ্নভাবে প্রকাশ করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এখনই ডিজিটাল মনিটরিং, আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও স্থায়ী নিরাপত্তা তদারকি টিম গঠন না করলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে।
একজন ব্যবসায়ী সংক্ষেপে বললেন, “আমরা পণ্য হারিয়েছি, কিন্তু তার চেয়েও বড় ক্ষতি হয়েছে আমাদের আস্থার।”
সারসংক্ষেপে:
-
আগুন লেগেছিল দুপুর ২টা ১০ মিনিটে, নিয়ন্ত্রণে আসে রাত ৯টা ১৮ মিনিটে
-
ফায়ার সার্ভিসের ৩৭ ইউনিট, সেনা–নৌ–বিমানবাহিনীর অংশগ্রহণ
-
ফ্লাইট বন্ধ ৬ ঘণ্টা, ২৫ জন আহত
-
কার্গো ভিলেজে কোটি কোটি টাকার শিল্প কাঁচামাল পুড়ে ছাই
-
তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন
-
বিশ্লেষকদের মতে, অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার “বড় ব্যর্থতা”
চোখের সামনেই পুড়তে থাকা সেই পণ্য, ধোঁয়ায় ঢেকে যাওয়া আকাশ আর বিধ্বস্ত ব্যবসায়ীদের হতাশ মুখ—সবকিছু মিলিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ অগ্নিকাণ্ড বাংলাদেশের বিমান ও বাণিজ্য ইতিহাসে একটি স্মরণীয় বিপর্যয়ের প্রতীক হয়ে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ