
ছবি: সংগৃহীত
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছে। বিশেষত ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে চলমান উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, ভারত যেকোনো সময় পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। তবে সেই সম্ভাব্য হামলার মোকাবিলায় পাকিস্তানও সর্বোচ্চ প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
সোমবার (৫ মে) ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, "আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যে, ভারত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে। যদি তারা হামলা করে, পাকিস্তান প্রতিরোধ করবে এবং শক্ত জবাব দেবে।" তিনি আরও বলেন, "আমরা কোনো ধরনের আগ্রাসনকে প্রশ্রয় দেব না। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে।"
প্রসঙ্গত, কাশ্মীরের পেহেলগামে সম্প্রতি একটি ভয়াবহ বন্দুক হামলায় বেশ কয়েকজন ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে। এই ঘটনার পর ভারত পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করে আসছে। ভারতের দাবি, হামলার নেপথ্যে রয়েছে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী, এবং ইসলামাবাদ এই গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। পাকিস্তান এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন দাবি করে আসছে এবং উল্টো ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তে আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছে।
পাক প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এই ঘটনায় স্বচ্ছ তদন্তের স্বার্থে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে হামলার পেছনে প্রকৃত দায়ীদের শনাক্ত করা যায়। সেই প্রসঙ্গে খাজা আসিফ বলেন, "এই তদন্তেই উঠে আসবে, আসলেই কি কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই হামলা চালিয়েছে, নাকি এটা ভারতের পরিকল্পিত অপারেশন ছিল, যার মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনের চেষ্টা করছে।"
খাজা আসিফ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও সরাসরি অভিযুক্ত করে বলেন, "মোদি সরকার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য গোটা অঞ্চলকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়া পরমাণু যুদ্ধের মুখে পড়তে পারে।" তিনি আরও বলেন, মোদির নেতৃত্বে ভারতের সরকার প্রায়শই সীমান্ত উত্তেজনা উসকে দিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সুবিধা নিতে চায়।
তিনি বলেন, "আমরা এমন প্রমাণ জাতিসংঘেও জমা দিয়েছি, যেখানে দেখা গেছে, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন করেছে। বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখোয়া এবং বেলুচিস্তানে।" পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করে আসছে যে, তারা সীমান্ত পেরিয়ে গোপনে সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িত।
আসিফ দাবি করেন, "আফগানিস্তান থেকে পরিচালিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী হামলায় ভারত পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। ভারতের এই কার্যকলাপ শুধু পাকিস্তান নয়, গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
এদিকে, পাকিস্তানের সামরিক বিশ্লেষকরাও এই মুহূর্তে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ইসলামাবাদের ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটি’র এক সাবেক অধ্যাপক বলেন, "ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বক্তব্য এবং সেনা মোতায়েনের ধরণ দেখে স্পষ্ট, তারা পুলওয়ামা-পরবর্তী ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর মতো নতুন কোনো সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাকিস্তানের উচিত সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখা।"
আঞ্চলিক রাজনীতিবিদরাও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, ভারত নির্বাচনী বছরে সীমান্ত উত্তেজনা কাজে লাগিয়ে অভ্যন্তরীণ সমর্থন আদায়ের কৌশল হিসেবে অতীতেও পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে। বিশেষ করে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জাতীয়তাবাদী আবেগকে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করে থাকে।
অন্যদিকে, কূটনৈতিক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চলছে। চীন, সৌদি আরব এবং তুরস্ক ইতোমধ্যে দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও সীমান্তে সহিংসতা না বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে।
তবে খাজা আসিফের কণ্ঠে ছিল অদম্য দৃঢ়তা। তিনি স্পষ্ট বলেন, "পাকিস্তান শান্তি চায়, কিন্তু আত্মসমর্পণ নয়। আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু কেউ আমাদের মাটি দখল করতে এলে আমরা পাল্টা জবাব দিতে বাধ্য হব।"
এমন সময়ে এই হুঁশিয়ারি এলো, যখন দক্ষিণ এশিয়া আগে থেকেই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সন্ত্রাসবাদ, শরণার্থী সমস্যা ও অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের যেকোনো ধরনের সংঘাত গোটা অঞ্চলের স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র: এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, দ্য ডন, জিও নিউজ, এএফপি
বাংলাবার্তা/এমএইচ