
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনীয় কর্তৃপক্ষ (পিএ) ইসরায়েলের বিধ্বংসী গাজা যুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বলে ঘোষণা করেছে—ধ্বংসস্তূপ অপসারণ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন, আন্তর্জাতিক সহায়তা নিয়ে গাজা পুনর্গঠনের পরিকল্পনা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) নির্বাহী কমিটির ওই ঘোষণা আনাদোলুর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য মনিটরের কাছে জানানো হয়েছে।
রামাল্লায় নির্বাহী কমিটির বৈঠকের পর প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বিধ্বংসী যুদ্ধের পরিণতি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন”—যার মধ্যে রয়েছে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করা, আহত ও গৃহহীনদের সহায়তা, জরুরি কাঠামোগত পুনর্বাসন, পুনরায় বসতি স্থাপন ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ। একই সঙ্গে মিশরের সহযোগিতায় গাজা পুনর্গঠন বিষয়ক একটি বৈশ্বিক সম্মেলন দ্রুত আয়োজনের পরিকল্পনা পাকা করা হয়েছে।
নির্বাহী কমিটি তাদের বিবৃতিতে মিশরের আহ্বানে সব ফিলিস্তিনি দল ও গোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি জাতীয় সংলাপ শুরু করার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা এটিকে ‘দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ঐক্য জোরদারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’ এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হওয়ার একটি সুযোগ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বৃহস্পতিবার মিশরের লোহিত সাগর উপকূলীয় শহর শারম আল-শেখে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের প্রায় দুই বছরের যুদ্ধোপসেশন বন্ধ করে যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা এসেছে। ওই ঘোষণার প্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাদের পুনর্গঠনের প্রস্তুতি কার্যকরভাবে ত্বরান্বিত করার পরিকল্পনা ঘোষণায় জোর দিয়েছে।
নির্বাহী কমিটির বিবৃতিতে পুনর্নির্মাণ কার্যক্রমকে প্রায় তিনটি স্তরে ভাগ করে দেখা হয়েছে—প্রাথমিক জরুরি তৎপরতা, মধ্যম মেয়াদী পুনর্বাসন ও দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ।
-
প্রাথমিক জরুরি তৎপরতা: ধ্বংসস্তূপ অপসারণ, মৃতদেহ উদ্ধারের শেষকাজ, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা স্থাপন, ত্রাণবস্ত্র ও খাদ্য সামগ্রীর সরবরাহ, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সাময়িক আশ্রয় এবং বৃহৎ پیمানায় শিশু ও বিধবা-অনাথদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
-
মধ্যম মেয়াদী পুনর্বাসন: ক্ষতিগ্রস্ত বাসস্থান পুনর্নির্মাণ, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র পুনর্গঠন, বিদ্যুৎ ও পানীয়জলের সরবরাহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা, স্কুল ও শিক্ষাব্যবস্থা পুনরায় চালু করা।
-
দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন: বন্দোবস্ত ও অর্থায়ন সংগ্রহ করে বড় ধরনের অবকাঠামো প্রকল্প (পথ, ব্রীজ, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বন্দর ও বাণিজ্যিক অবকাঠামো) বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ—আয়োজিত শিল্প, কৃষি পুনরুজ্জীবন ও বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ।
নির্বাহী কমিটি বলেছে, মিশরের সহযোগিতায় গাজা পুনর্গঠন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন দ্রুত আয়োজন করা হবে, যাতে আরব ও ইসলামি দেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা, দাতা দেশ ও বেসরকারি খাত অংশগ্রহণ করবে। সম্মেলনের প্রধান লক্ষ্য হবে—পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ, নিরাপত্তা ব্যবস্থার রূপরেখা নির্ধারণ এবং স্থানীয় অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাঠামো তৈরি করা।
সম্মেলনের এজেন্ডায় বিবেচ্য পর্বগুলোর মধ্যে রয়েছে:
-
তাত্ক্ষণিক তহবিল বরাদ্দ ও তা কীভাবে দ্রুত পৌঁছে দেয়া যাবে;
-
বাস্তবায়ন ও তদারকির জন্য স্বচ্ছতা ও আর্থিক তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থাপনা;
-
নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো যেখানে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, সরকারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা অংশ নেবেন;
-
গাজায় সীমিত বা বৃহত্তর প্রশাসনিক তফসিল নির্ধারণ—কীভাবে স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী গঠন করা হবে তা নির্ধারণ;
-
দখলকৃত ভূখণ্ডে পুনর্বাসন ও শরণার্থী প্রত্যাবাসনের নীতিমালা।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা ন্যায়বিচার পরিকল্পনা সম্পর্কিত ২০ দফা প্রস্তাব ঘোষণা করেছেন—যেখানে উল্লেখ রয়েছে সব ইসরায়েলি বন্দি মুক্তি বিনিময়ে প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তি, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি স্থাপন এবং ধাপে ধাপে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার। পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপে উল্লেখ করা হয়েছে—হামাসকে বাদ দিয়ে গাজায় একটি নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গঠন, ফিলিস্তিনি ও আরব-ইসলামী দেশগুলোর যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ অংশগ্রহণ ও হামাসের নিরস্ত্রীকরণ। তাছাড়া আরব ও ইসলামি দেশগুলো অর্থায়নে গাজা পুনর্গঠনের প্রসঙ্গও উল্লেখ ছিল।
যদিও আরব ও মুসলিম দেশগুলো ঐ পরিকল্পনাটিকে স্বাগত জানিয়েছে, অনেক পর্যবেক্ষক এবং কিছু সরকারি কর্মকর্তা উল্লিখিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের আগে আরও আলোচনা ও সমঝোতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন—বিশেষত গাজায় প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তন ও নিরাপত্তা গঠনের দিকগুলোকে নিয়ে। ফিলিস্তিনীয় পক্ষের একটি বড় অংশই মনে করে, গাজার পুনর্গঠন যেন কোনোভাবে তাদের রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন ও অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে—এবং আন্তর্জাতিক তহবিল এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া প্রশাসনিক পুনর্গঠন বাস্তবসম্মত নয়।
পুনর্গঠন কার্যক্রম বাস্তবায়নের পথে একাধিক চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট রয়েছে:
-
নিরাপত্তা: থেকে চলমান तनाव ও সীমিত সংঘাতের ঝুঁকি, উপকরণ ও তহবিলের পরিবহনে বাধা, এবং পুনর্গঠনে নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
-
অর্থায়ন: বৃহৎ পরিমাণ তহবিল প্রয়োজন হবে; কোন দেশগুলো কীভাবে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে, তা রাজনৈতিক-আঞ্চলিক অঙ্গীকারের ব্যাপার।
-
প্রশাসনিক কাঠামো: হামাস, ফাতাহ ও অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে যে প্রশাসনিক গঠন করা হবে তা ন্যায্যভাবে জনগণের বিশ্বাস অর্জন করবে কি না—এখানে রাজনৈতিক সংলাপ প্রধান ভূমিকা রাখবে।
-
মানবিক সুরক্ষা ও স্বাধীন পুনর্বাসন ব্যবস্থাপনা: শরণার্থী ও গৃহহীনদের দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন কিভাবে করা হবে, এবং ভূমি-সম্পত্তি ও ক্ষতিপূরণ কীভাবে বিতরণ করা হবে—এসব বিষয় সমাধান করা জরুরি।
-
স্বচ্ছতা ও তদারকি: তহবিলের ব্যবহার ও প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা না থাকলে দুর্নীতি ও অনিয়মের আশঙ্কা থাকবে, যা পুনর্গঠনকে ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
নির্বাহী কমিটি মিশরের আহ্বানকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, সব ফিলিস্তিনি দলের অংশগ্রহণে একটি জাতীয় সংলাপ দরকার—এবং এটি গাজার পরবর্তী প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা কাঠামো নির্ধারণে চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করবে। তারা আশা ব্যক্ত করেছে যে, জাতীয় সংলাপ হামাসকে বাদ না দিয়ে, বরং সর্বস্তরের অংশীভূতিতে হবে—যাতে স্থানীয় জনগণের স্বীকৃতি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়।
আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে ফিলিস্তিনি পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন ও স্বার্থ নানা রকম। জোরালোভাবে বলা হচ্ছে—গাজার স্থায়ী পুনর্নির্মাণ কেবল অর্থায়ন নয়, রাজনৈতিক সমাধানও দাবি করে। বিশেষ করে আরব ও মুসলিম বিশ্ব, ইউরোপীয় দেশগুলো এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই পুনর্গঠনে অংশগ্রহণে আগ্রহী হলেও তারা পুনর্গঠন কার্যক্রমের পূর্বশর্ত হিসেবে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা দেখতে চায়।
প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের নির্বাহী সদস্যরা মনে করেন, পুনর্গঠন কেবল ধ্বংসস্তূপ সরানো নয়; এটি একটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ—যেখানে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ, মানবাধিকারের গ্যারান্টি এবং অর্থনৈতিক টেকসইতা নিশ্চিত করা হবে।
গাজা পুনর্গঠন একটি ব্যাপক, বহু-মুখী ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষের ঘোষণা অনুযায়ী প্রস্তুতিগুলো যতই শিগগির শেষ করে নেওয়া হোক, বাস্তবায়নের সাফল্য নির্ভর করবে রাজনৈতিক ইচ্ছা, আন্তর্জাতিক সমর্থন, আর্থিক তহবিল এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের উপরে। শারম আল-শেখে যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে—সেটি যদি টেকসই হয় এবং মিশ্র অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়, তবে গাজার মানুষদের জন্য পুনর্জাগরণ ও স্বনির্ভরতার পথ খুলে যেতে পারে। অন্যথায়, পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা অতৃপ্তিকর আর অনিশ্চিত অবস্থায় আটকে যেতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ