
ছবি: সংগৃহীত
বছরের পর বছর ধরে ওয়াশিংটন এবং তেল আবিবের নীতিনির্ধারকরা একটিই বার্তা বারবার পুনরাবৃত্তি করছেন: ‘হামাসকে নিরস্ত্র করতে হবে, গ্রুপটিকে ভেঙে ফেলতে হবে এবং তাদের গাজা ছেড়ে যেতে হবে।’ এই দাবিটি যেকোনো টেকসই শান্তির জন্য একটি অ-আলোচনাযোগ্য পূর্বশর্ত হিসেবে উপস্থাপিত হচ্ছে। তবে ইতিহাসের পাণ্ডিত্য এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই যুক্তিটি অনেক সময় হাস্যকরভাবে সরল ও নির্বোধ মনে হয়।
ইতিহাস এবং আধুনিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ
যুক্তি সহজ—“হামাস যদি তার অস্ত্র ত্যাগ করে, শান্তি আসবে”—কিন্তু এটি বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। হামাসের ইতিহাস এবং আদর্শিক প্রেক্ষাপটকে বোঝার জন্য এক নজরে দেখা প্রয়োজন, কেন সশস্ত্র আন্দোলন কখনো তার অস্ত্র নিঃশর্তভাবে ত্যাগ করেনি। আধুনিক ইতিহাসে হামাসকে এমন কঠিন নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে দেখা গেছে, কারণ তাকে যা করতে বলা হচ্ছে—নিরস্ত্রীকরণ—সেটি মানে ভবিষ্যতের রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ব বা নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি ছাড়া সবচেয়ে মূল্যবান শক্তি উৎস ত্যাগ করা।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, দুর্বল পক্ষ যখন শক্তিশালী পক্ষের ওপর আস্থা রাখে, তখন তার পরিস্থিতি ১৪৯২ সালের গ্রানাডার ইতিহাসের মতো হয়ে ওঠে। গ্রানাডার শেষ মুসলিম দুর্গটি ক্যাথলিক রাজা ফার্দিনান্দ ও রানী ইসাবেলার কাছে আত্মসমর্পণ করে। চুক্তিতে মুসলমানদের জীবন, সম্পত্তি, চলাফেরা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুই বছরের মধ্যেই সেই প্রতিশ্রুতি অকার্যকর হয়ে যায় এবং মুসলমানরা তাদের অধিকার হারান। এই ইতিহাস সরাসরি শিক্ষা দেয় যে অসম ক্ষমতার পরিস্থিতিতে প্রতিশ্রুতি কোনো বাস্তব নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নয়।
অস্ত্র সমর্পণ বনাম বেঁচে থাকার কৌশল
হামাসের দৃষ্টিকোণ থেকে অস্ত্র সমর্পণ করা মানে তাদের ভবিষ্যৎ পুরোপুরি তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া। তারা জানে যে প্রতিশ্রুতি যদি ভঙ্গ হয়, তবে আর কোনো নিরাপদ বিকল্প থাকবে না। আধুনিক সামরিক ইতিহাসে এমন উদাহরণ রয়েছে ভিয়েতনাম কংগের ক্ষেত্রে। প্যারিস শান্তি চুক্তিতে তাদের রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, যদি তারা অস্ত্র ত্যাগ করে, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করে। রাইফেল আঁকড়ে ধরে তারা মার্কিন সামরিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করেছিল এবং পরিণামে মার্কিন ইতিহাসের অন্যতম ব্যর্থ যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল।
এই ইতিহাসে স্পষ্ট যে অসম যুদ্ধে অস্ত্র আলোচনাযোগ্য নয়—এটি বেঁচে থাকার একটি অপরিহার্য কৌশল। হামাসের সামরিক শাখাই তাদের ক্ষমতার মূল উৎস। অস্ত্র, অস্ত্রশক্তি এবং সশস্ত্র উপস্থিতি ছাড়া তাদের দাবিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া সম্ভব নয়।
আইআরএ: একমাত্র ব্যতিক্রম
অন্যদিকে, আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (আইআরএ) দীর্ঘদিন অস্ত্র ধরেছিল এবং এক পর্যায়ে তাদের রাজনৈতিক শাখা সিন ফেইন সরকারের অংশ হয়ে নিশ্চিত ও অর্থবহ ভূমিকা অর্জনের পর অস্ত্র ত্যাগ করে। তবে এটি কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ছিল না; এটি ছিল একমাত্র উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম যা প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে কোনো সশস্ত্র আন্দোলন নিজস্ব অস্ত্র ছাড়বে না। বন্দিদের মুক্তি ও রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পর এই পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
হামাসের অবস্থা ও নীতি
হামাসের জন্য অস্ত্র সমর্পণ মানে কেবল অস্ত্র ত্যাগ নয়, এটি তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক অস্তিত্বের মূল ভিত্তি ত্যাগ করা। তারা জানে যে, অস্ত্রের শক্তি ছাড়া আন্তর্জাতিক সংলাপের ক্ষেত্রে তাদের দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে না। এটি কেবল নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, এটি অধিকার, সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রশ্ন।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের চাহিদা হচ্ছে হামাসকে নিরস্ত্র করা, কিন্তু বাস্তবতায়, এই দাবি ইতিহাসের নানা শিক্ষা ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে প্রায় অসম্ভব। আধুনিক ইতিহাসে দেখা গেছে, সশস্ত্র আন্দোলন কখনো তাদের অস্ত্র শূন্যে ত্যাগ করেনি। হামাসের অস্ত্র তাদের কৌশলগত নিরাপত্তা, রাজনৈতিক প্রভাব ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার একটি অপরিহার্য হাতিয়ার।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের দাবির সঙ্গে বাস্তবতার ব্যবধান অনেক বড়। ইতিহাস এবং আধুনিক যুদ্ধকৌশল প্রমাণ করে, অসম ক্ষমতার পরিস্থিতিতে অস্ত্র ত্যাগ কোনো নিরাপত্তা বা শান্তি নিশ্চিত করতে পারে না। হামাসের অস্ত্র তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক অস্তিত্বের মূল ভিত্তি। যে পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হবে, সশস্ত্র আন্দোলনের অস্ত্র ত্যাগের দাবি শুধুই একটি রাজনৈতিক এবং বাস্তব-বিরুদ্ধ অঙ্গীকার।
সূত্র: মডার্ন ডিপ্লোমেসি
বাংলাবার্তা/এমএইচ